ক্রিসমাসের সওদায় অভিনেত্রী মালবিকা। — সুদীপ্ত ভৌমিক
ঝলমলে সবুজ ঝাউগাছ। ডালে ডালে টুপটাপ ঝুলছে সোনালি-রুপোলি তারা, ঘণ্টা, টুপি, মোজা। পায়ে পায়ে দাঁড়িয়ে ইয়াব্বড় বড় সান্তা ক্লজের পেপারকাট। ফ্রুটকেকের গন্ধে গা ভাসানো ভিড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে সিডি-র দোকান থেকে বাজছে ‘উই উইশ ইউ আ মেরি ক্রিসমাস’। উপরে উপরে দেখে মনে হয়, উৎসবের মেজাজে দিব্যি জমেছে নিউ মার্কেটে। কিন্তু একটু ভিতরে কান পাতলেই ব্যবসায়ীদের অসন্তুষ্টি। ক্ষোভ। ক্রেতাদের খুশির হাসিতেও টানাটানির ভাঁজ। সান্তার দরাজ ঝোলার মুখে নগদ-সঙ্কটের ফাঁস যে ভালই চেপে বসেছে, মালুম পড়ছে বড় দিনের মুখে।
হাজরার বাসিন্দা, গৃহবধূ সুনয়না বিশ্বাস প্রতি বছর বড়দিনের আগে ছেলেমেয়েকে নিয়ে নিউ মার্কেটে আসেন। এ বছরও এসেছেন, তবে অন্য বারের মতো দিলখোলা মেজাজে নয়। ‘‘পুজোর বাজারের মতোই বড়দিনের বাজার হয় আমাদের। কেক-কুকিজ-পেস্ট্রি-কাজু ছাড়াও ক্রিসমাস ট্রি, সান্তা ক্লজ, ঘর সাজানোর জিনিস, এমনকী নতুন জামাকাড়ও। কিন্তু এ বার সান্তা আর গাছ বাদ। ক্যাশই তুলতে পারছি না, বাজার কী করে হবে!’’
নিউ মার্কেটের খুব কম ব্যবসায়ীই কার্ডে বিক্রিবাটা করেন। বৃদ্ধ কেক ব্যবসায়ী মহম্মদ ইরশাদ বললেন, ‘‘এ বাজারে নগদই চলে আসছে এত বছর ধরে। বড়দিনের সময়ে মুঠো মুঠো টাকা ওড়ে এখানে। কখনও ভাবিনি, পয়সাওয়ালা লোকেরাও খালি হাতে ঘুরে বেড়াবেন!’’ কেক-পেস্ট্রির ব্যবসা ভাল রকম ধাক্কা খেয়েছে বলে জানালেন আর এক ব্যবসায়ী শেখ আব্বাস আলি। ‘‘গত বছর এই সময়ে দিনে দশ হাজার টাকারও কেক বিক্রি করেছি। এ বার পাঁচও হচ্ছে না,’’ বললেন তিনি। তাঁর আক্ষেপ, বিক্রি পরের কথা, নিজেরাই এমন নোট সমস্যায় পড়েছি, কেক বানানোর কাঁচামালও কিনতে পারিনি।
বাটার, ক্রিম, কাজু, চেরি— এ সব কেক-উপকরণ বিক্রেতা সন্তোষ শর্মা জানালেন, ব্যবসা একটু কম ঠিকই। কিন্তু যতটা ভয় পেয়েছিলেন, ততটাও খারাপ নয়। একই মত ঘর সাজানোর জিনিস বিক্রেতা সইফুল হকের। ‘‘অসুবিধা খুবই হচ্ছে। ভেবেছিলাম আরও ভুগতে হবে। ততটাও খারাপ অবস্থা নয় কেনাবেচার। দু’হাজার টাকার নোট ভাঙিয়ে দিতে না-পারায় বহু ক্রেতাকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।’’ যা হচ্ছে তাতে খুশি নন আর এক বিক্রেতা শেখ রসুল আমিন। বললেন, ‘‘খাওয়ার টাকা নেই, ঘর কী সাজাবে!’’
বাচ্চাদের জামাকাপড় আর শীতপোশাক বিক্রেতা আনিসুল মিদ্যা বলছেন, ‘‘কার্ডের মেশিন বসাতেই হবে। নইলে ব্যবসা করা মুশকিল।’’ নোট ফতোয়ার পর থেকেই কেনাবেচা তলানিতে। আনিসুল ভেবেছিলেন বড়দিনের সময়ে নিউ মার্কেটে গুছিয়ে নিতে পারবেন ব্যবসা। ফাঁকা দোকানে বসে আনিসুল বললেন, ‘‘দেশের ভাল তো বুঝতে পারছি না, কিন্তু ব্যবসার খারাপটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’’
নিউ মার্কেটের অন্যতম পুরনো ও বিখ্যাত কনফেকশনারি শপের কর্তা জেসিকা ব্যাপটিস্ট জানালেন, এত বড় দোকান হওয়া সত্ত্বেও কার্ডের ব্যবস্থা নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবসা একটু কম এই নগদ-সঙ্কটে। যাঁরা নিয়মিত খদ্দের, তাঁরা সকলেই আসছেন। ‘‘অসুবিধা থাকবে নানা রকম, উৎসবও তো থাকবে তার মধ্যেই। মানুষ কেকও খাবে। হয়তো একটু কম খাবে,’’ বললেন জেসিকা। কিন্তু দোকানের বাইরে বসা আর এক ছোট ব্যবসায়ী মানু চট্টোপাধ্যায় জানালেন, ‘‘অনেক দোকান নামের জোরে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। আগে তো কেক পড়তে পেত না দোকানে, এখন সাজিয়ে বসেই আছি। তার মধ্যে বহু ক্রেতাকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে দু’হাজার টাকার খুচরো দিতে পারছি না বলে।’’