দেবাঞ্জন দেব ফাইল চিত্র
ভুয়ো প্রতিষেধক চক্রের পাণ্ডা দেবাঞ্জন দেব কি আদতে নামী কর্পোরেট সংস্থার হয়ে ‘ফান্ড-রেজ়ার’-এর কাজ করত? তার গত এক বছরের কার্যকলাপ দেখে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্তকারীদের মধ্যে। যত টাকা সে তুলেছিল, তার বড় অংশই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিচয়ের আড়ালে তোলা হয়েছিল বলে পুলিশ সূত্রের খবর। এই প্রেক্ষিতেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি ও সেগুলির কার্যকলাপের উপরে কড়া নজরদারি চালানো নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের কাছে লালবাজারের তরফে প্রস্তাব পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে খবর।
রাজ্য জুড়ে এই মুহূর্তে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মর্যাদার সঙ্গে কাজ করে চলেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠতে শুরু করে করোনার প্রথম ঢেউয়ের পরবর্তী সময় থেকে। পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা ওই সব সংস্থার মাথা হিসেবে রয়েছেন ‘নেতা’ বা ‘দাদারা’। রাতারাতি সমাজকর্মী হয়ে উঠতে তাঁদের অনেকেই নানা সংস্থা ও সরকারি প্রকল্প থেকে মোটা টাকা আমদানি করেছেন বলে অভিযোগ। এই একই অভিযোগ উঠেছিল রাজ্য সরকারের তরফে ক্লাবগুলিকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার কথা ঘোষণা হওয়ার পরে। ‘সোশ্যাল রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট’-এ রাতারাতি ক্লাব হিসেবে নাম নথিভুক্ত করাতে প্রবল ভিড় দেখা যায় টোডি ম্যানসনে। একই জিনিস হয় আমপান এবং ইয়াস ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সাহায্যের নামে। প্রশ্ন উঠেছে, সেই চক্রেরই কি অন্যতম মাথা হয়ে উঠেছিল দেবাঞ্জন?
লালবাজারের তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসাবে নথিভুক্ত বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে দেবাঞ্জনের নাম জড়িত রয়েছে। এমনিতে বর্তমানে সাত জন সদস্যকে নিয়ে ‘সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট’-এ নাম নথিভুক্ত করে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি করা যায়। এ ছাড়া, যেখানে সম্পত্তিগত বিষয় রয়েছে সেখানে ন্যূনতম দু’জন সদস্যকে নিয়ে ট্রাস্ট গঠনের মধ্যে দিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসেবে নাম রেজিস্ট্রেশন করানো যায়। আর এক রকম ‘প্যান ইন্ডিয়া’ রেজিস্ট্রেশন হয় নিজাম প্যালেস থেকে। সেখানে রেজিস্ট্রেশনের পরে কোনও সংস্থা গোটা দেশ জুড়ে কার্যকলাপ চালাতে পারে। কিন্তু এই সব নথির কোনওটিই দেবাঞ্জনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির থেকে যথাযথ ভাবে পাওয়া যায়নি। পুলিশের অনুমান, প্রশাসনিক মহলে পরিচিতি কাজে লাগিয়ে এই আইনের পথটি ফাঁকি দিয়েছিল দেবাঞ্জন।
প্রতি বছর বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি তাদের লভ্যাংশ থেকে সিএসআর (কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি) খাতে খরচ করে। কোনও কর্পোরেট সংস্থা তাদের পছন্দের
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এর জন্য টাকা দিতে পারে। অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে দেওয়া হচ্ছে বলে রসিদ লেখানো হলেও আদতে অত টাকা দেওয়া হয় না। যে সংস্থা এমন রসিদ দিতে রাজি থাকে, তারা তত বেশি ওই কর্পোরেট সংস্থার পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে জায়গা পায়। এ ছাড়াও, কিছু ব্যক্তি ‘ফান্ড-রেজার’ হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় গিয়ে বলেন, বড় কর্পোরেট সংস্থার ২০
লক্ষ টাকার ফান্ড তাদের পাইয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তাদের রসিদ দিতে হবে ২৫ বা ৩০ লক্ষ টাকার। মাঝের এই ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা ফান্ড-রেজার ব্যক্তির ‘আয়’। পুলিশের অনুমান, এই কাজে হাত পাকিয়ে ফেলেছিল দেবাঞ্জন।
তবুও উঠছে বহু প্রশ্ন। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এমনিতেই কড়াকড়ি করা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। যে কোনও সংস্থার রেজিস্ট্রেশনের জন্য পাকা ঠিকানা ও ভাড়া বাড়ির ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালার ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মিউটেশনের যথাযথ কাগজও দিতে হবে। প্রতি বছর অডিট রিপোর্টও চাই। তা সত্ত্বেও কী করে এত আইন এড়িয়ে গেল দেবাঞ্জন? যুগ্ম কমিশনার পদ মর্যাদার লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “এ ক্ষেত্রে কী ভাবে ঘটেছে সবটা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় এমন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে আরও কড়াকড়ি করা হবে।”