প্রতীকী ছবি।
বন্যা, সাইক্লোন, জলমগ্ন অবস্থা-সহ বর্ষার সময়ে যে কোনও ধরনের বিপর্যয় সামলাতে প্রতি বছর কলকাতা পুরসভা একটি নথি প্রকাশ করে। উদ্দেশ্য, বর্ষাকালীন বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য শহরবাসী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুরসভার নিজস্ব কর্মী, রাজ্য সরকারের অন্যান্য দফতর-সহ বিভিন্ন স্তরে সচেতনতা গড়ে তোলা। নথির মুখবন্ধে প্রচলিত উদ্ধৃতির প্রসঙ্গ টেনে লেখা হয়—‘সুস্থ হয়ে ওঠার থেকে আগাম প্রতিরোধ গড়ে তোলা ভাল’।
চলতি বছরেও সেই নথি প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও পরিস্থিতি বলছে, পুর নথিতে উল্লেখ করা বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবের তফাত কয়েক যোজন। কারণ বৃষ্টি হলে জলমগ্ন হওয়া যেমন শহরের ভবিতব্য, তেমনই বোধহয় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়াটাও! কখনও ঝড়-বৃষ্টিতে ছিঁড়ে পড়া বিদ্যুৎবাহী তার, কখনও আবার হুকিংয়ের তারের বিপদ ওত পেতে থাকছে জমা জলে। সেই তার অতর্কিতে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। প্রতি বার দুর্ঘটনার পরে বিদ্যুতের খুঁটি কার, ছিঁড়ে পড়া তার-ই বা কাদের, তা নিয়ে চাপানউতোর চলে। বেআইনি বিদ্যুৎ সংযোগের বিরুদ্ধে অভিযান, মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, পরের বছর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না—নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু বর্ষার শহরে পরিস্থিতি অপরিবর্তিতই থাকে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত দেড় মাসের মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শহরে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। এমনিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর নিরিখে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে ১৪তম স্থানে। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’ (এনসিআরবি)-র সর্বশেষ রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে রাজ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ৩০৪টি। মৃত্যু হয়েছিল ২৯৪ জনের (২৫৬ জন পুরুষ, ৩৮ জন মহিলা)। বাকিরা আহত হয়েছেন। ২০১৮ সালে সারা দেশে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ১২,১৫৪ জনের। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ১৩,৪৩২ জন। তার পরেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রফেসর সুগত মুন্সির মতে, সারা বছর ধরে এই ধরনের তারের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। তাঁর কথায়, ‘‘একই সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটার পরে পুরসভা ও বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার মধ্যে চাপানউতোর বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। কাদের দায়িত্ব, সে ব্যাপারে স্বচ্ছতা দরকার। না হলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’’ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগেরই অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অরিন্দম কুমার শীল আবার জানাচ্ছেন, ঝড়-জলে তার ছিঁড়ে পড়লে এমন ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাঁর কথায়, ‘‘প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটা করা সম্ভব। প্রাণহানির থেকে এলাকাভিত্তিক সাময়িক ভাবে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া ভাল!’’
কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য পদক্ষেপ করা হয়েছে। খোলা ফিডার বক্স থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা এড়াতে সিইএসসি-সহ অন্য দফতরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করা হচ্ছে। সিইএসসির তরফেও সোমবার জানানো হয়েছে, প্রতি বছর বর্ষার আগে পুরসভার সঙ্গে সমন্বয় রেখে কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হয় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আলো ও বিদ্যুৎ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য মনজর ইকবাল বলছেন, ‘‘জলমগ্ন এলাকা চিহ্নিত করে সেখানকার ফিডার বক্সগুলির উচ্চতা বাড়ানো হচ্ছে। যাতে জল জমলেও
সেগুলি জলের উপরে থাকে। খোলা তার কোথাও রয়েছে কি না, সে ব্যাপারেও নজরদারি চালানো হচ্ছে।’’ যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের বক্তব্য, এই কথা তো প্রতি বছরই বলা হয়। অথচ দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিদ্যুৎবাহী তারকে মরসুমি বৃষ্টির মতো ‘মরসুমি বিপদ’ হিসেবে দেখা হয়। প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘পরিস্থিতির সমাধানসূত্র খোঁজার পদ্ধতির মধ্যেই মূল সমস্যা রয়ে গিয়েছে। বিদ্যুতের তারের বিপদকে শুধুমাত্র বর্ষার সময়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ সারা বছর এই বিপদ মাথায় নিয়েই সবাই চলাফেরা করেন।’’
আর সেই চলাফেরার সময়েই অতর্কিতে নেমে আসে বিপদ। বছরের পর বছর ধরে!