উত্তরপ্রদেশে গঙ্গায় ভাসছে দেহ। এ কি মৃতের গঙ্গাপ্রাপ্তি— শতাব্দীপ্রাচীন প্রথারই পুনরাচরণ? নদীর পাড়ে বালিতে দেখা যাচ্ছে আধপোঁতা মৃতদেহ, সে কি কোভিড-প্রকোপে মৃতের সৎকার-অব্যবস্থার করুণ চিত্র নয়? ঘনিয়ে উঠেছে তর্ক।
মৃতদেহ এ ভাবে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা কি আজকের? উনিশ শতকের শহর কলকাতাও সাক্ষী, নিমতলা ঘাট ও কাশী মিত্র ঘাটের গঙ্গায় অর্ধদগ্ধ দেহ ভাসিয়ে সৎকার করা হত— ধর্মীয় সংস্কারের দোহাই দিয়ে। প্রতি বছর পাঁচ হাজার মৃতদেহ নিক্ষিপ্ত হত নদীতে, এমন হিসেবও পাওয়া যাচ্ছে নথিতে। জনৈক পত্রলেখক ইংলিশম্যান পত্রিকায় নিমতলা শ্মশানের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, “যাঁরা সেখানে মৃত আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবদের সৎকার করতে যান, তাঁরা কেবল বীভৎস দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতেই বাধ্য হন তা নয়। অনেক সময় পা দিয়ে মাড়াতে হয় মৃতদেহও। কারণ সেগুলো অগ্নিদগ্ধ করে ফেলে রাখা হয় পোড়া কাঠ এবং অন্যান্য মৃতদেহের স্তূপের উপর।”
১৮৫৪ সালে নদীকে জলদূষণ থেকে বাঁচাতে ইংরেজ সরকার আইন করে মৃতদেহ নদীর জলে ফেলা বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু বাধা এসেছিল রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ থেকে। প্রসন্নকুমার ঠাকুর সরকারকে সতর্ক করেন এই বলে যে, আইন করে এই ব্যবস্থা বন্ধ করতে গেলে তা হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কারে হস্তক্ষেপের শামিল হবে। সরকার পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। তবে, বিকল্প উপায় হিসেবে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কিছু নৌকো নামান এবং ‘মুর্দাফরাস’ নিয়োগ করেন, যাঁদের কাজ ছিল নদীর বুকে ভেসে যাওয়া মৃতদেহগুলি ডুবিয়ে দেওয়া। কিন্তু সব মৃতদেহ জলে ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব হত না। ফলে অব্যাহত থাকে জলদূষণ।
অবস্থা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল ১৮৬২ সালে প্রবল জ্বরের মহামারি শুরু হলে। নদীর উচ্চগতিতে ভাসিয়ে দেওয়া রাশি রাশি মৃতদেহ ভেসে এল কলকাতায়। কর্মক্লান্ত মুর্দাফরাসরা বেশি পারিশ্রমিক দাবি করে বসলেন। এমনকি, এক দিন ধর্মঘট করে যোগ দিলেন না কাজে। এই পরিস্থিতিতে সরকার কঠোর পদক্ষেপ করতে বাধ্য হল। তখনকার পুলিশ কমিশনার সরকারকে জানালেন, কড়া আইন ছাড়া গঙ্গায় মৃতদেহ ভাসানোর রীতি ও গঙ্গাদূষণ রোধ করা যাবে না। অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে ১৮৬২ সালে আইন পাশ করা হল গঙ্গায় মৃতদেহ ফেলা বন্ধ করতে। মৃতদেহ নদীতে ফেলার অপরাধে শাস্তির ব্যবস্থা হল। সেই ক্ষমতা দেওয়া হল ম্যাজিস্ট্রেটদের।
১৮৬৪-র ১ জুন বাংলার তদানীন্তন গভর্নর সিসিল বিডন-এর চিঠি থেকে জানা যায়, নদীতে মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়ার রীতি প্রায় বন্ধ। সরকারি আইনের বিরুদ্ধে এ বার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ কলকাতার শিক্ষিত সমাজ উপলব্ধি করতে পেরেছিল, কোনও সভ্য সমাজে ধর্মীয় সংস্কারের দোহাই দিয়ে এই অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর প্রথাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। নদী হবে নির্মল, তার বুকে ভাসবে নৌকো, তীরে আশ্রয় পাবে শহর, সভ্যতা।
শিল্পিত জীবন
হাই স্কুলে পড়ার সময়ই ‘আর্ট’ মন কেড়েছিল হুগলির কোন্নগরের ভূমিপুত্রের। সেই টানেই বোধহয়, উত্তরপাড়া কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়েও পরে সরকারি আর্ট কলেজে চলে আসেন ঈশা মহম্মদ (১৯৩৩-২০২১) (ছবিতে)। সেখানেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে বৃত্তি। ১৯৫৮ থেকে কখনও সরকারি দফতরে কর্মী, বা আর্ট কলেজে সাময়িক সময়ের শিক্ষক। ১৯৬৮-তে বিদেশযাত্রা, জার্মানিতে গ্রাফিক্স আর্টের, ইউরোপ-ভ্রমণে বিশ্বশিল্পেরও পাঠ নেন তিনি। দেশে ফিরে ‘ক্যালকাটা পেন্টার্স’-এর সদস্য হন, নিয়মিত প্রদর্শনীতে পান শিল্পীর প্রতিষ্ঠা। তাঁর ছবিতে মানুষের উপস্থিতিই সর্বাগ্রে, বলিষ্ঠ রেখায় দৈনন্দিন জীবনকথা— কখনও সাররিয়ালিস্টিক, কখনও প্রতিকৃতিপ্রধান। সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন, এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতিও। চলে গেলেন গত ১১ মে।
বৈচিত্রের দিন
অতিমারির প্রথম তরঙ্গে, রুদ্ধ জীবনে, তালাবন্ধ দেশে লড়াই করে এগিয়েছে শিল্প। আন্তর্জাল ও ডিজিটাল মাধ্যমকে আঁকড়েছেন শিল্পীরা, প্রত্যন্ত প্রান্তেও মগ্ন হয়েছেন সৃষ্টিতানে। বাংলার পটচিত্রীরা এঁকেছেন করোনাসুর, রাবণহাতা আর নাগফণী বাজিয়ে জীবনের জয়গান গেয়েছেন মরুশিল্পীরা, যোগ দিয়েছেন কর্মশালায়। সুরবৈচিত্রের পাল তুলে এ বার দ্বিতীয় তরঙ্গকেও ডিঙিয়ে যাচ্ছেন শিল্পীর দল। সংস্কৃতির এই সংলাপ ও প্রসারকে সামনে রেখে ২১ মে দিনটিকে ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র দিবস’ ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। শিল্পে সৃজনে দিনটি উদ্যাপনের ডাক দিয়েছে ‘বাংলানাটক ডট কম’। গ্রাফিক আর্ট, অলঙ্করণ, ব্যঙ্গ রচনা, স্লোগান, পদ্য, নাচ ও গানের ভিডিয়ো তৈরি করে পাঠাতে পারেন অনূর্ধ্ব-ত্রিশ বয়সিরা। বিষয়, বৈচিত্রের শক্তিতে উজ্জ্বল বিশ্ব। বিশদ সংস্থার ওয়েবসাইটে।
সার্ধদ্বিশতবর্ষে
বঙ্গীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ, ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের ২৫০ বছরের সূচনা আজ, ২২ মে। অতিমারিকালে উদ্যাপন আন্তর্জালে, ‘রামমোহন রায় সার্ধদ্বিশতবর্ষ জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি’র উদ্যোগে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় ‘আধুনিক ভারতের উদ্বোধক’ বিষয়ে বলবেন শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, পরে তা শোনা যাবে ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ ইউটিউব চ্যানেলে। রামমোহন-চর্চায় সনিষ্ঠ, প্রয়াত অধ্যাপক গৌতম নিয়োগীর স্মরণসভা আজ বিকেল সাড়ে ৪টেয়, ‘সমাজ’ ফেসবুক পেজে। আগামী কাল সন্ধে সাড়ে ৬টায় ‘রামমোহন রায় ২৫০ বছর পুনর্মূল্যায়ন সমিতি’র ‘রামমোহন ও যুক্তিবাদ’ আলোচনায় থাকবেন রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়, রাহুল গোবিন্দ, দীপেশ চক্রবর্তী।
বাবু বৃত্তান্ত
পড়শি অবিনাশবাবুর মুখে নিরামিষাশী হওয়ার কথা শুনে প্রোফেসর শঙ্কুর মন্তব্য, ইলিশভাজার গন্ধ পেলে যে নিউটন আর অবিনাশের মধ্যে পার্থক্য থাকে না, তা তাঁর বেশ জানা! ও দিকে ছ’ফুট পার করা প্রখর রুদ্রের স্রষ্টা, যিনি সঙ্গে ভোজালি নিয়ে ঘোরেন, উটের পিঠে চড়তেই তাঁর সব বীরত্ব উবে যায়। ফিল্মে সুযোগ পেয়ে নাচতে থাকেন পটলবাবু, ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং-এর সাক্ষাতে বঙ্কুবাবু। সত্যজিৎ-সৃষ্ট অমর চরিত্র হলেও ফেলুদা-শঙ্কুর ক্যারিশমায় কিছুটা চাপা পড়ে যান অনাথবাবু, গোলাপীবাবু, বাতিকবাবু, সাধনবাবু, নকুড়বাবুরা। এঁদের নিয়েই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের অ-মৃত পত্রিকার সাম্প্রতিক ডিজিটাল সংখ্যা— মানিকবাবুর বাবুরা।
আঁধারে আলো
‘‘আলো, আলো কই? এ-ঘরে কি একদিনও আলো জ্বলবে না?’’ সুদর্শনার এই সংলাপে শুরু হয় রাজা নাটক। কিন্তু সে সংলাপ যদি ব্যক্ত হয় এক দৃষ্টিহীন অভিনেতার মুখে, রবীন্দ্র-নাটকে অন্ধকার কি অন্য অর্থ পায় তখন? বলছিলেন শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় ও রাজদীপ কোনার, ‘পদাবলী’ আয়োজিত ‘অন্ধকারের রবীন্দ্রনাথ’ আন্তর্জাল-অনুষ্ঠানে। দৃষ্টিহীন অভিনেতাদের নিয়ে ভারতের প্রথম নাট্যদল ‘ব্লাইন্ড অপেরা’ এবং ‘অন্যদেশ’ নাট্যচর্চা করছে প্রায় আড়াই দশক, শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে রক্তকরবী, রাজা, ডাকঘর। ‘নিরালোক’ শিল্পীদের অভিনয়ে রক্তকরবী দেখার কথা লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ বুকের ভেতরে গিয়ে পৌঁছনো সেই ভাষাটি জানা গেল।
মেলাবেন তিনি
‘রাজধানী’তে একটি বৌদ্ধ বিহারের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন অনাগারিক ধর্মপাল। সেই পরিকল্পনা যখন রূপায়িত হল, তত দিনে রাজধানী সরে গেছে দিল্লিতে। তবু কলেজ স্কোয়ারের কাছে শ্রীধর্মরাজিকা চৈত্য বিহার এ শহরে বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, বুদ্ধের পবিত্র দেহাস্থি আছে এখানে। শহরে ছড়িয়ে বহু বৌদ্ধ মন্দির— মধ্য কলকাতার বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহার কলকাতার অন্যতম পুরনো বৌদ্ধ মন্দির, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে টেরিটিবাজার যাওয়ার মুখে আছে মায়ানমার বৌদ্ধ মন্দির, ট্যাংরায় তাইওয়ানের বৌদ্ধ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত মন্দির ফো গুয়াং শান। ইডেন উদ্যানে আছে বর্মি প্যাগোডা। দক্ষিণে লেক টেরেস রোডে আছে জাপানি বৌদ্ধ মন্দির, চক্রবেড়িয়ায় তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি কর্মা গণ মঠ। তাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা জড়িয়ে মধ্যমগ্রামের ওয়াত তাই জ্ঞানবিহার-এর সঙ্গে। দক্ষিণ দমদমের যশোর রোডে আছে চিনা বৌদ্ধ মন্দির। বৈশাখী তথা বুদ্ধপূর্ণিমা সমাগত— বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণকে মিলিয়ে দেয় এই শুভক্ষণ। তেমনই, বৌদ্ধ ধর্মের নানা শাখাকেও মিলিয়ে দেয় এই শহর। নীচের ছবিতে ২০১৪ সালে মহাবোধি সোসাইটির মন্দিরে বুদ্ধজয়ন্তী।
এই প্রথম
বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিবিজ্ঞান ও গণিতের ছাত্র গিরিশ কারনাডকে টানত ‘ল্যান্ড অব টি এস এলিয়ট’, ভাবতেন, কবিতা নয়, অঙ্কের সুচর্চায় সে দেশে পৌঁছনো সহজ হবে। ইব্রাহিম আলকাজ়ির নাট্যক্ষেত্রে তরুণ কারনাড দেখেছেন চেকভ, ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ, পিরানদেল্লো, পরে রোডস স্কলারশিপ নিয়ে অক্সফোর্ডে গিয়ে শেক্সপিয়র, ব্রেশট। দিগন্ত খুলে-যাওয়া সেই শিল্পবোধের প্রেরণায় টি এস এলিয়ট (ছবিতে), আগাথা ক্রিস্টি-সহ বহু লেখক-চিন্তকের স্কেচ আঁকা শুরু করেন গিরিশ। এক তথ্যচিত্রের সূত্রে সেই সব স্কেচ নিয়ে গিরিশের সঙ্গে নিবিড় আলাপ করেছিলেন সুদেব সিংহ, স্কেচগুলি তাঁকে দেন শিল্পী স্বয়ং। সুদেবেরই রূপায়ণ-ভাবনায় এই প্রথম গিরিশের আঁকা স্কেচগুলি নিয়ে আন্তর্জালিক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে শহরের ডিজিটাল শিল্প-পরিসর ‘আর্টওয়েভ ইন্ডিয়া’র ওয়েবসাইটে, ১৯ মে গিরিশের জন্মদিনে। সন্ধেয় ‘তাঁতঘর ফিল্মস’ ও ‘আর্টওয়েভ’-এর উদ্যোগে আলোচনায় ছিলেন বিভাস চক্রবর্তী, হিরণ মিত্র, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত প্রমুখ।
যেন মনে রাখি
শিক্ষা সংস্কার প্রকল্প হাতে নিয়েই ইংরেজি শিক্ষায় জোর দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, গণিত ও বিজ্ঞানের পাশাপাশি পাশ্চাত্য দর্শন অধ্যয়নও জরুরি, জানিয়েছিলেন। গ্রন্থরচনাকালে বিজ্ঞানীদের জীবনী লিখেছিলেন বাংলায়— বলছিলেন আশীষ লাহিড়ী। ‘বাংলায় যুক্তিবাদ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ প্রসঙ্গে ৯ মে কবি ‘সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত স্মারক বক্তৃতা’ দিলেন তিনি, কবির জন্মদিনে বিভাব পত্রিকা ও ‘বিস্তার’ (চিটাগং আর্ট কমপ্লেক্স)-এর যৌথ উদ্যোগে। ধর্মীয় আধিপত্যবাদ ও কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার বিরুদ্ধে ব্যক্তির ভাবনা, বিজ্ঞানচেতনা ও জ্ঞানচর্চায় গুরুত্ব দিতেন বিদ্যাসাগর, এই সময়ে দাঁড়িয়ে সে কথা বার বার মনে করা জরুরি।