স্বজনহারা: উত্তরাখণ্ডে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত মদনমোহন ভুঁইয়ার বাড়ির সামনে তাঁর ভাইপো নীলাদ্রিশেখর ভুঁইয়া। বৃহস্পতিবার, গড়িয়ার শ্রীনগর এলাকায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
শেষ দেখার প্রতীক্ষায় গোটা পাড়া যেন নেমেছিল পথে। বৃহস্পতিবার গড়িয়ার শ্রীনগর এলাকায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা প্রতিবেশীদের। সকলের মুখেই এক প্রশ্ন, দেহ কখন আসবে? ট্রেকিং করতে গিয়ে উত্তরাখণ্ডের টিহরী গাড়োয়ালে গাড়ি দুর্ঘটনায় মদনমোহন ভুঁইয়া-সহ তিন জনের মৃত্যুর খবর পেয়ে বুধবার রাতেই রওনা হয়েছিলেন তাঁদের এক আত্মীয় মানস ভুঁইয়া। তাঁর সঙ্গে ফোনে েযাগাযোগ রেখে যাচ্ছিলেন মদনমোহনবাবুর ভাইপো নীলাদ্রিশেখর ভুঁইয়া। কাগজপত্র মিটিয়ে দেহ কখন আনা সম্ভব, বলতে পারছিলেন না তিনিও।
নীলাদ্রি বলেন, ‘‘সকালেই হৃষীকেশ এমসে সকলের ময়না-তদন্ত হয়েছে। কিন্তু কাগজপত্রের ঝামেলা মিটিয়ে দেহ আনতে রাত হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। দেহ গড়িয়ার বাড়িতে এনে কিছু ক্ষণ রেখে পাথরপ্রতিমার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে।’’ জানা গিয়েছে, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া মিটিয়ে দেহ তুলে দেওয়া হয়েছে পরিবারের হাতে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ দেহ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেন।
পরিবার সূত্রের খবর, বছর সতেরো আগে পাথরপ্রতিমা থেকে গড়িয়ায় এসে বাড়ি করেন মদনমোহনবাবু। স্ত্রী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সেখানেই থাকতেন। কয়েক মাস আগে দোতলা বাড়ির একতলা কয়েক জনকে ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। ওই ভাড়াটেদের এক জন বললেন, ‘‘মাঝেমধ্যে নীচে নেমে আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। যাওয়ার দিন আমাদের কাছে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। বাড়ির কোনও কাজে যদি লাগে, তার জন্য। এ ভাবে একটা পরিবার শেষ হয়ে গেল, ভাবতেও পারছি না।’’
যাওয়ার দিন বেরোনোর আগে মদনমোহনবাবু বাড়ির দিকে খেয়াল রাখতে বলেছিলেন প্রতিবেশীদেরও। প্রতিবেশী যশ সাউ বলেন, ‘‘যাওয়ার দিন সকালে কাকু ডেকে বললেন বাড়িটা একটু খেয়াল রাখতে।’’ আবর্জনার গাড়ি এলে বাড়ির সামনের রাস্তাটা যাতে পরিষ্কার করা হয়, সেই অনুরোধও করেছিলেন। সাতেপাঁচে না থাকা গোটা ভুঁইয়া পরিবারের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না প্রতিবেশীরা। প্রতি বছর কোথাও না কোথাও ট্রেকিংয়ে গেলেও একটানা এত দিনের পরিকল্পনা আগে করেননি মদনমোহনবাবুরা। এ বারই প্রথম পনেরো দিনের পরিকল্পনা করেছিলেন। ৬ জুন ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বুধবার দুপুরে দুর্ঘটনার খবর উত্তরাখণ্ড প্রশাসনের তরফে এসে পৌঁছয় গড়িয়ায়। মদনমোহন ভুঁইয়া, ঝুমুর ভুঁইয়া, নীলেশ ভুঁইয়া এবং ব্যারাকপুর শ্যামাশ্রীপল্লির দেবমাল্য দেবনাথ ও নৈহাটির প্রদীপ দাসের মৃত্যুর খবর আসে।
আক্ষেপ যাচ্ছে না রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পিন্টু দেবনাথেরও। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘মাঝেমধ্যেই আমাকে ফোন করতেন মদনমোহনবাবু। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে পরামর্শ দিতেন। কয়েক দিন আগে ফোন করে নিজেই বললেন, ট্রেকিং করতে যাচ্ছেন। বিশ্বাস করতে পারছি না যে সেটাই শেষ কথা।’’
একই অবস্থা দেবমাল্য ও প্রদীপের পরিবারেরও। প্রদীপবাবুর দিদি বুলবুল দাস বলেন, ‘‘পোস্ট অফিস থেকে ভাইয়ের একটি চিঠি আনতে গিয়েছিলাম। তখনই ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়। বেলা ১১টার সেই কথাই যে শেষ কথা হবে, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।’’ ঘটনার রাতে প্রদীপবাবুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন স্থানীয় বিধায়ক পার্থ ভৌমিক এবং নৈহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান অশোক চট্টোপাধ্যায়। পার্থবাবু বলেন, ‘‘প্রশাসনিক আধিকারিকেরাবিষয়টি দেখছেন। সব রকম সহযোগিতা করা হচ্ছে।’’
দেবমাল্যবাবুর মৃত্যুর খবর আসার পর থেকেই কান্না থামছে না পরিবারের। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, আগেও চার-পাঁচ বার ট্রেকিংয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার দিন পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যান ব্যারাকপুর পুরসভার চেয়ারম্যান উত্তম দাস। বুধবার দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ স্ত্রীর সঙ্গে দেবমাল্যবাবুর শেষ বার কথা হয়। বৃদ্ধা মাকে এখনও ছেলের মৃত্যুর খবর জানায়নি পরিবার। একমাত্র মেয়েকেও ঘটনার কথা না জানিয়ে তাকে এক আত্মীয়ের বাড়ি রেখে দেবমাল্যবাবুর স্ত্রী, দাদা এবং আর এক আত্মীয় রওনা দিয়েছেনদেহ আনতে।