সমবেত: কালিকাপুরের বয়স্ক পরিচর্যা কেন্দ্রে চলছে থেরাপি। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
অশক্ত শরীর ও জীর্ণ বলিরেখাটুকুই শেষ কথা বলবে, কোথায় লেখা আছে?
গানের তালে তালে বয়স্ক অবয়বগুলি তখন উড়িয়ে দিচ্ছে সাদা আরশির কাঠখোট্টা বাস্তবতা। হাতে একটা পুতুল, বালিশ বা বল নিয়ে খেলতে খেলতে ৭৫ কিংবা ৬৫-র ‘মাসিমা’ বা ‘দাদুভাই’-এর বয়সও ‘কমতির দিকে’ ঢলে পড়ছে। এমন দৃশ্য ক্রমশ দেখা যাচ্ছে কলকাতার সরকারি সাহায্যপুষ্ট বয়স্ক পরিচর্যাকেন্দ্রে। রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রম বা দরকারে কোনও প্রবীণদের বাড়িতেও তাল-ছন্দ-সুরের মলম পৌঁছে দিতে শুরু হচ্ছে প্রবীণদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার এক নতুন প্রকল্প।
আকাশের গোধূলির অস্তরাগ যতই মোহময় দেখতে লাগুক, জীবনের গোধূলিতে অনেক সময়েই বিষাদের কুয়াশা ঘিরে থাকে। মৃত্যুভয়, অসুস্থতা, অসহায়তা, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা—নানা ধরনের বিপন্নতায় প্রবীণেরা অনেকেই গভীর অবসাদে তলিয়ে যান। সেই অন্ধকার থেকে তাঁদের টেনে তুলতেই ‘ডান্স অ্যান্ড মিউজ়িক সাইকোথেরাপি’। কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ণ মন্ত্রকের একটি সহযোগী সংস্থার তরফে শনিবার প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও সুস্থ ও ইতিবাচক ভঙ্গিতে বয়স্কদের বাঁচার চেষ্টাটুকুর কিছুটা পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
কালিকাপুরে আগেই দুঃস্থ, অশক্ত প্রবীণদের নাচ-গানের শুশ্রূষার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। উদ্যোগটির নেপথ্যে রয়েছেন বার্ধক্যবিজ্ঞান বিশারদ ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী ও ইংল্যান্ডের কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যানসার চিকিৎসা নিয়ে গবেষণারত এষা চক্রবর্তী। এষা ছোট থেকে ভরতনাট্যমেও তালিম নিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিলেতের গবেষণাপর্বেই প্রবীণ থেকে ক্যানসার রোগীদের জন্য নাচ-গানের শুশ্রূষার গুরুত্ব জানতে পারি।’’ পশ্চিমবঙ্গে জেলের বন্দি বা পাচার চক্রের শিকার মেয়েদের উপরে নাচ-গানের চর্চা একটা ইতিবাচক ছাপ ফেলেছে। অবসাদ কাটাতে নাচ-গানকে কাজে লাগানোর কিছু কৌশল বিলেত থেকেও রপ্ত করেছেন এষা।
ঠিক কী ভাবে প্রবীণদের মনে আলো জ্বালবে এই সব সংস্কৃতি-চর্চা?
ক্যানসারে চিকিৎসাধীন রোগী বা ধর্ষিতা নারীকে ছন্দে ফেরানোর কয়েকটি চেষ্টার উদাহরণ থেকেও অনুপ্রেরণা খুঁজেছেন তিনি। যেমন, ক্যানসারের চিকিৎসায় চুল পড়ে যাওয়া রোগিণীকে হয়তো একটি চিরুনি হাতে কিছু মনের ভাব প্রকাশ করতে বলা হল। হতেই পারে চিরুনিটা দেখে প্রথমে তাঁর সেটা রাগে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তালিমের মাধ্যমে সেই চিরুনিটা হাতেই নানা ভঙ্গিতে নিজের জ্বালা-যন্ত্রণা উগরে দিতে পারেন মানুষটি, তাতে যন্ত্রণা অনেকটাই ফিকে হবে। ধর্ষণের শিকার কোনও নারীও চরম অবসাদে নিজেকে ঘেন্না করতে পারেন! এষার মতে, ‘‘হয়তো তাঁর হাতে একটা টিপ, গয়না বা অন্য কোনও সরঞ্জাম দিয়ে কয়েকটি মুদ্রা রপ্ত করা শেখানো হল। নিজের প্রতি হারানো ভালবাসা ফিরিয়ে আনার এটাও একটা প্রক্রিয়া হতে পারে!’’ ‘‘তবে প্রবীণদের ভাল রাখার এই চেষ্টা সব সময়ে সমান ফলপ্রসূ নাও হতে পারে! গানে-নাচে সাধারণত সবারই মন ভাল হয়। কিন্তু কেউ হয়তো জড়তা ভাঙতে বেশি সময় নিলেন, এমনও হতে পারে!’’ — বলছেন ইন্দ্রাণী। শুশ্রূষার নয়া প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক সূচনা-পর্বে ছিলেন মনোরোগ চিকিৎসক সুশান্ত হালদার, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ স্থবির দাশগুপ্তেরা। স্থবিরবাবু একটি বিষয়ে সতর্ক করছেন। ‘‘অসুখের মোকাবিলায় কিন্তু ওষুধ, শৃঙ্খলা তার নিজের নিয়মেই চলবে। এর পাশাপাশি, গানবাজনা-নাচে জীবন সহনীয় হয়ে উঠতে পারে।’’ এই ধরনের চেষ্টাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বাগত জানাচ্ছেন ডাক্তারবাবুরাও।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।