ফাইল চিত্র।
বছর ১৬ আগে আমেরিকায় যখন বিধ্বংসী রূপ নিয়ে হারিকেন ক্যাটরিনা আছড়ে পড়েছিল, তখনই অশনিসঙ্কেত দেখেছিলেন আবহবিজ্ঞানীরা। তাঁরা বুঝেছিলেন, গত তিন দশক ধরে ঘূর্ণিঝড়ের চরিত্রে যে পরিবর্তন এসেছে, ক্যাটরিনা তার নিদর্শন মাত্র। এ রকম ঘটনা আরও ঘটবে। এর জন্য সতর্কতা ও সময়ে প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া পথ নেই।
বছর ঘুরেছে। আর একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য ও তার আকস্মিক সংখ্যা বৃদ্ধি আবহবিজ্ঞানীদের সেই সতর্কবার্তাই সত্যি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বেই সাধারণ নিম্নচাপ ক্রমশ গভীর নিম্নচাপ থেকে ‘শক্তিশালী’ (সিভিয়র), ‘অতি শক্তিশালী’ (ভেরি সিভিয়র), ‘মহা শক্তিশালী’ (এক্সট্রিমলি সিভিয়র) অথবা ‘সুপার সাইক্লোন’-এর আকার নিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়।
গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, নিসর্গ, বুলবুল, ফণী, মহা, হিকা, কিয়ার, বায়ু, আমপান, টাউটে-সহ একাধিক ঘূর্ণিঝড় বিভিন্ন সময়ে আছড়ে পড়েছে দেশ ও সংলগ্ন অঞ্চলে। সেই তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন ইয়াস। এর অন্যতম কারণ হল সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি, জানাচ্ছেন আবহবিজ্ঞানীরা। তাঁদের বক্তব্য, ঘূর্ণিঝড় নিজের ‘পুষ্টি’ সঞ্চয় করে জলীয় বাষ্প থেকে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণেই জল বাষ্পে পরিণত হয়। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিরিয়োলজি’-র ‘মনসুন মিশন’-এর সিনিয়র বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ঘূর্ণিঝড় টাউটে যত ক্ষণ গুজরাত উপকূল ধরে এগোচ্ছিল তত ক্ষণ সে বিধ্বংসী রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু যেই মুহূর্তে ভূপৃষ্ঠে প্রবেশ করেছিল, তখন সে শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাঁর কথায়, ‘‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গত ৩০ বছরে অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বা ক্যাটেগরি ফাইভ ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা ক্রমশ বেড়েছে। আগে তুলনামূলক ভাবে যা কম হত।’’
আবহবিজ্ঞানীরা এ-ও জানাচ্ছেন, প্রাক্ বর্ষায় বিভিন্ন ধরনের ‘সাইক্লোনিক স্ট্রাকচার’ তৈরি হয়। প্রথম ধাপে তৈরি হয় ‘লো প্রেশার এরিয়া’, যা হল নিম্নচাপের পূর্বাবস্থা। তার পরে সেটি নিম্নচাপে পরিণত হয়। যা ক্রমশ পর্যাপ্ত জলীয় বাষ্প ও অন্যান্য সহায়ক পরিবেশ পেলে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। আগে এই ধরনের ‘সাইক্লোনিক স্ট্রাকচার’-এর বেশির ভাগই নিম্নচাপ বা গভীর নিম্নচাপেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেইগুলিই শক্তিশালী, অতি শক্তিশালী, মহা শক্তিশালী বা ‘সুপার সাইক্লোন’-এ পরিণত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টিং’-এর বিজ্ঞানী উপল সাহার কথায়, ‘‘যেমন বেশি ক্ষণ সমুদ্রে থাকার কারণে জলীয় বাষ্প শোষণ করে ইয়াস নিজের বিস্তৃতি বাড়িয়ে নিয়েছে বা ‘সাইক্লোনিক ভর্টেক্স’ তৈরি করেছে। যে কারণে তার তীব্রতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের যে কোনও ঘূর্ণিঝড় এ ভাবেই ক্যাটেগরি থ্রি, ক্যাটেগরি ফোর-এর আকার নিচ্ছে।’’
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জেগেছে, ঘূর্ণিঝড়ের এই রুদ্রমূর্তি থেকে বাঁচার পথ কী?
আবহবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মহা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আসবে। তবে পার্থসারথিবাবুর কথায়, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাভাস নিখুঁত থেকে নিখুঁততর হচ্ছে। যা অতীতে ভাবা যেত না। ফলে ঠিক সময়ে পূর্বাভাস ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির মাধ্যমে প্রাণহানি রোখা সম্ভব।’’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট’-এর রেসিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিভাগের প্রধান চন্দন ঘোষ আবার জানাচ্ছেন, সব সময়েই প্রশাসনিক ভরসায় না থেকে বিপর্যয় এড়াতে জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণও জরুরি। তাঁর কথায়, ‘‘ঝড় আসার আগেই যদি নিজের বাড়ির চত্বরের গাছের ডাল ছেঁটে দেওয়া যায়, তা হলে গাছ উপড়ে পড়ে বিপত্তি এড়ানো সম্ভব। বিদ্যুতের তারের ক্ষেত্রেও একই ভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।’’
ফলে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বা তার সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেও নিখুঁত পূর্বাভাসই ভরসা হতে পারে। যার উপরে ভিত্তি করে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে প্রাণহানি রোখা সম্ভব। আর সেটাকেই সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ের-আবহে ‘পাখির চোখ’ করা দরকার বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।