প্রতীকী ছবি।
জনঘনত্ব— এই একটি সূত্রেই বাঁধা পড়ে গেল কোভিড-১৯ এবং ঘূর্ণিঝড় আমপান।
ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় সংক্রমণের হার যে তুলনামূলক বেশি, তা আগেই জানিয়েছেন বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা। এ বার আবহবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আমপান সব থেকে ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করেছে। তাঁদের বক্তব্য, ভারতকে ঘিরে যে সমুদ্রগুলি রয়েছে, তাতে উদ্ভূত কোনও ঘুর্ণিঝড়ের সংখ্যা প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি টাইফুন ও আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট হারিকেনের থেকে অনেকটাই কম। কিন্তু এ দেশের জনঘনত্বের কারণেই সেই ঘূর্ণিঝড়গুলির ধ্বংসের প্রভাব অনেক বেশি মাত্রায় হয়।
‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিয়োরোলজি’-র (আইআইটিএম) ‘মনসুন মিশন’-এর সিনিয়র বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘জনঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে ক্যাটেগরি-ফাইভ সাইক্লোন ভারতীয় উপকূলে আছড়ে পড়লে তার ক্ষতির পরিমাণ বেশিই হবে।’’ আমপান যে উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, কলকাতা, হাওড়া-সহ একাধিক এলাকায় নিজের ধ্বংসচিহ্ন রেখে যাবে, তা আগেই জানিয়েছিল আলিপুর আবহাওয়া দফতর। বাস্তবেও তেমনই হয়েছে। বরং আরও বিস্তৃত হয়েছে তার ধ্বংসক্ষেত্র। হিসেব বলছে, জনঘনত্বের বিচারে রাজ্যের প্রথম সারিতেই রয়েছে আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বসবাসকারীর সংখ্যা উত্তর ২৪ পরগনায় ২ হাজার ৪৬৩ জন (জনঘনত্বের নিরিখে রাজ্যে তৃতীয়), দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৮১৯ জন, কলকাতায় ২৪ হাজার ২৫২ জন, হাওড়ায় ৩ হাজার ৩০০ জন, নদিয়ায় ১ হাজার ৩১৬ জন এবং হুগলিতে ১ হাজার ৭৫৩ জন।
অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নমূলক গবেষণার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক গ্রোথ’ (আইইজি)-এর নাবার্ড চেয়ার প্রফেসর সৌদামিনী দাস জানাচ্ছেন, ভৌগোলিক ভাবে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এমনিতেই স্পর্শকাতর এলাকা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমত, এখানে জনঘনত্বের পরিমাণ বেশি। দ্বিতীয়ত, এই এলাকাগুলি, বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার অবস্থান অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলে। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি।’’ তবে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের একাংশের বক্তব্য, আমপান আছড়ে পড়ার আগেই উদ্ধারকাজ শুরু হওয়ায় কিছুটা রক্ষা পাওয়া গিয়েছে। আইআইটিএম-এর বিজ্ঞানী আর কৃষ্ণনের কথায়, ‘‘আমরা পুরো বিষয়টির উপরে নজর রেখেছিলাম। এনডিআরএফ, উপকূলরক্ষী বাহিনী-সহ সকলের প্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতার ফলে উদ্ধারকাজ সম্ভব হয়েছে।’’ তার পরেও আমপানের যে বিধ্বংসী প্রভাব পড়েছে এবং প্রাণহানি হয়েছে, তার অন্যতম কারণ জনঘনত্ব।
যেমন ভাবে জনঘনত্বের দিকে উপরের সারির রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলেই সার্স-কোভ-২ সংক্রমণের হার তুলনামূলক ভাবে বেশি। তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, গুজরাত জনঘনত্বের নিরিখে দেশের প্রথম ১৫টি রাজ্যের মধ্যে রয়েছে। আবার কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিল্লিতে জনঘনত্বের হার দেশে সর্বাধিক। ঘটনাচক্রে ওই রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলই আবার সংক্রমিত রোগীর নিরিখে দেশের প্রথম পাঁচে অবস্থান করছে।
যদিও ‘ইন্ডিয়ান ভাইরোলজিক্যাল সোসাইটি’-র সেক্রেটারি জেনারেল বিজ্ঞানী যশপাল সিংহ মালিক বলেন, ‘‘শুধু কোভিড-১৯ কেন, জনঘনত্ব বেশি হলে সংক্রমণজনিত যে কোনও রোগই বেশি ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। এখন কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি হওয়ার কারণে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে।’’ ‘মাইক্রোবায়োলজিস্ট সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’-র প্রেসিডেন্ট এ এম দেশমুখ বলছেন, ‘‘সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য জনঘনত্বের ভূমিকা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু মনে রাখতে হবে কোভিড ১৯-এর মৃত্যুর কারণ শুধু জনঘনত্ব নয়। সেখানে কো-মর্বিডিটির মতো একাধিক বিষয় রয়েছে।’’
আরও এক ভাইরোলজিস্টের মতে, ‘‘জনঘনত্বই যদি গুরুত্বপূর্ণ হত, তা হলে বিহার, পশ্চিমবঙ্গে তো সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা মহারাষ্ট্র, দিল্লির থেকে বেশি হত। কারণ, জনঘনত্বের নিরিখে এই দু’টি রাজ্য দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। অতএব জনঘনত্ব কারণ ঠিকই, কিন্তু একমাত্র কারণ কি না, তা গবেষণা সাপেক্ষ।’’