কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
আমপানের তাণ্ডবলীলার তিন দিন পরেও শহরের বিভিন্ন এলাকার যা অবস্থা, তাতে পুরসভার প্রস্তুতির অভাবের পাশাপাশি পুর কর্তৃপক্ষের সার্বিক ব্যর্থতার ছবিটাই ফুটে উঠেছে বলে অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে পুরসভার অনেকেরই বক্তব্য, প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এখন পুরসভার দায়িত্বে থাকলে অবস্থা এতটা খারাপ হত না। বস্তুত, শোভন নিজেও শনিবার পুরসভার ব্যর্থতার দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘রোগী ভেন্টিলেশনে চলে যাওয়ার পরে চিকিৎসা শুরু হচ্ছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘পুরসভা হয়তো এর গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। আমপানের মোকাবিলায় যা যা করণীয় ছিল, তাতে ঘাটতি রয়েছে।’’ পুরসভার অন্য একটি অংশ অবশ্য মনে করছে, শোভনবাবু ঠিক বলছেন না।
আর এক প্রাক্তন মেয়র, সিপিএমের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও পুর ব্যর্থতার দিকেই আঙুল তুলেছেন। ২০০৯ সালে আয়লার সময়ে বিকাশবাবু ছিলেন শহরের মেয়র। তবে রাজ্যের মন্ত্রী এবং আরও এক প্রাক্তন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় আবার শোভনবাবুকে একহাত নিয়ে বলেছেন, ‘‘আমার আমলে এত বড় ঝড় হয়নি। শোভনের সময়ে এ ধরনের ঝড় তো দূর, জোরে বাতাসও বয়নি।’’
গত বুধবার কলকাতায় আমপান আছড়ে পড়ার পরে প্রায় ৮০ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। এখনও শহরের বহু জায়গায় বিদ্যুৎ নেই, জল নেই। রাস্তা আটকে রয়েছে ভেঙে পড়া গাছে। দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা বিক্ষোভ দেখাতে অবরোধ করেছেন। সকলেরই ক্ষোভ স্থানীয় পুর প্রশাসন এবং সিইএসসি-র বিরুদ্ধে। তাঁদের প্রশ্ন, ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা পাওয়ার পরেও কেন এত ভোগান্তি?
বিকাশবাবুর অভিযোগ, প্রশাসন প্রস্তুত ছিল না। তাঁর মতে, ‘‘পুরসভার কাজের বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। কিন্তু বর্তমান সরকারে সবই কেন্দ্রীভূত। মুখ্যমন্ত্রী না বললে কোনও কাজই হয় না। সবাই ওঁর অপেক্ষায় থাকেন। আমপানের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে বলে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম অবস্থা হচ্ছে।’’ তাঁর দাবি, আয়লার সময়ে কাজের বিকেন্দ্রীকরণ করেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গিয়েছিল। এই ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা যে আয়লার থেকেও বেশি ছিল, তা স্বীকার করেই তিনি বলেন, ‘‘আয়লার পরে পুরসভার বিপর্যয় মোকাবিলায় জোর দেওয়া হয়েছিল। এত দিনে তা আরও সক্রিয় করা জরুরি ছিল।’’
এ দিন জোর বিতর্ক তুললেও শোভনবাবু মুখে বলেন, ‘‘ঘোলা জলে মাছ ধরার মানসিকতা আমার নেই। তবে এই ঝড়ের পরে পুরসভার কাজ দেখে যন্ত্রণা হচ্ছে। ছ’-সাত দিন আগে থেকেই পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছিল। কেন আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হল না? অতীতে বিপর্যয় মোকাবিলা কী ভাবে হয়েছে, তা কারও মনে না-ও থাকতে পারে। কিন্তু রেকর্ড তো রয়েছে। সেটা দেখেই পরিকল্পনা করা যেত।’’
গাছ কাটা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘শুনছি, এক-একটা গাছ কাটতে তিন-চার ঘণ্টা লাগছে। কেন লাগবে? বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে গাছ কাটতে এত সময় লাগার কথা নয়। আসলে কোথায়, কে কাজ করবেন, কার কী দায়িত্ব, বরোয় নোডাল অফিসার কারা থাকবেন, হেড অফিসে কারা থাকবেন, সেই পরিকল্পনায় খামতি ছিল। শুধু ইলেকট্রিক সাপ্লাইকে দোষ দিলে হবে না। ওদের গাইড করলেই তাতে ফল মিলত।’’
পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিমেরও সমালোচনা করে শোভন বলেন, ‘‘উনি যে দফতরের মন্ত্রী, সেই দফতরেরই অধীন কলকাতা পুরসভা। মেয়রও ছিলেন তিনি। আমি হলে দুটো পদে থাকতাম না।’’
শোভনবাবুর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ফিরহাদ বলেন, ‘‘১৭৩৭ সালের পরে এত বড় বিপর্যয় কলকাতায় আর হয়নি। শহরকে সচল ও পুনর্গঠন করাই এখন আমাদের মূল কাজ। কে কী বললেন, তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দু’তিন দিনেই শহরবাসী পুরসভার ভূমিকা দেখতে পাবেন।’’
প্রাক্তন মেয়র সুব্রতবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘প্রকৃতি বিরুদ্ধে গেলে কিছু করার থাকে না। এত বড় শহর লন্ডভন্ড। পুরসভাকে দ্রুত কাজ করতে হবে।’’ বিক্ষোভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘জল ও বিদ্যুতের মতো প্রয়োজনীয় জিনিস না-মিললে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা পুর প্রশাসনের কাছে শিক্ষণীয়।’’
গাছ কাটায় দেরি নিয়ে প্রাক্তন মেয়র বলেন, ‘‘পুরসভাকে আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি রাখতে হবে। বিদেশে দেখেছি, ব্লেডে কাগজ কাটার মতো করে গাছ কাটা হয়। এ শহরেও সেই প্রযুক্তি প্রয়োজন।’’ তিনি জানান, তাঁর বাড়ির কাছেও একটি গাছ পড়েছিল। সেটি কাটতে রাত কাবার হয়ে যায়।