বিধ্বস্ত ধর্মতলা—নিজস্ব চিত্র
আশঙ্কা যা ছিল, শহরের বুকে তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি তাণ্ডব চালাল অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আমপান। প্রায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘণ্টা চারেকের সেই তুমুল ঝড়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ— লন্ডভন্ড হয়ে গেল গোটা কলকাতা। প্রাণ গেল তিন জনের। এ দিন ঝড়ের সময়ে রিজেন্ট পার্ক থানা এলাকায় পাঁচিল চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে এক মহিলা ও তাঁর ছেলের। তবে তাঁদের নাম জানা যায়নি। তালতলা থানা এলাকার নুর আলি লেনে জলে বিদ্যুতের তার পড়ে থাকায় তড়িদাহত হয়ে মহম্মদ তৌহিদ এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর মিলেছে। তবে রাত পর্যন্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি।
বুধবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, শহর জুড়ে উপড়ে পড়েছে শ’তিনেক গাছ। বহু জায়গায় ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ ও বাতিস্তম্ভ। ভেঙেছে জীর্ণ বাড়িও। বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়ে অন্ধকার নেমে আসে বহু এলাকায়। আলিপুর আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, মে মাসে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের নিরিখে এ দিন তৈরি হয়েছে নতুন রেকর্ড। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২৪৪.২ মিলিমিটার।
এ দিন সন্ধ্যায় পুর ভবনে নিজের ঘরে বসে পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘আমপান এতটা ভয়াবহ হবে ভাবিনি। গোটা শহর লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। তিনশোরও বেশি গাছ, কিছু বিদ্যুৎস্তম্ভ ও গোটা সাতেক বাড়িও ভেঙেছে।’’
অথচ, আমপানের মোকাবিলায় কলকাতা পুর প্রশাসন পুরোপুরি তৈরি বলে ২৪ ঘণ্টা আগেও দাবি করেছিলেন পুরকর্তারা। গাছ পড়ার খবর পেলেই পুরসভার কর্মীরা গাছ কাটার কাজে লেগে পড়বেন, এমনটাই জানানো হয়েছিল। সেই মতো পুরসভার ১৬টি বরোয় গাছ কাটার জন্য দু’টি করে বিশেষ দলকে রাখা হয়েছিল। ছিল গাছ কাটার স্বয়ংক্রিয় করাত, স্বয়ংক্রিয় মই ও ক্রেন।
আমপান কলকাতায় ঢোকার আগে এ দিন দুপুরে শহর জুড়ে ৪০-৫০ কিলোমিটার বেগে যে ঝড় বয়ে যায়, তাতেই নিউ আলিপুর, বেহালা, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, গড়িয়াহাট-সহ আরও কিছু এলাকায় গাছ পড়তে থাকে। পুরসভা ও পুলিশের বাহিনী পৌঁছেও যায় সেই সব এলাকায়। ফিরহাদ হাকিমও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে শহর পরিদর্শনে বেরোন। তার পরেই আলিপুর ও গড়িয়াহাটে গাছ কাটা শুরু হয়। এর মধ্যেই খবর আসে, বহু জায়গায় গাছ ভেঙে
বিদ্যুতের তারে পড়েছে। অনেক জায়গায় আবার ট্রামলাইনের তার জড়িয়ে যায় ভেঙে পড়া গাছের ডালে। পুরসভার কন্ট্রোল রুমে মুহুর্মুহু ফোন আসতে থাকে গাছ বা বিদ্যুতের স্তম্ভের ভেঙে পড়ার খবর জানাতে।
গড়িয়াহাটে গাছ উপড়ে পড়ে ট্রামলাইনের তারের উপরে। এর পরেই নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ আসে, রাতে শহরের কোথাও গাছ কাটা যাবে না। তত ক্ষণে খবর আসে, ওয়েলিংটনে ট্র্যাফিক সিগন্যাল ভেঙে গিয়েছে। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের কাছেও একটি বড় গাছ ভেঙে পড়েছে ট্রামের তারে। এর পরেই ফিরহাদ জানিয়ে দেন, যে হারে বিদ্যুতের তারের উপরে গাছ ভেঙে পড়েছে, তাতে রাতে গাছ কাটা ঝুঁকির হয়ে যাবে। তাই এ দিন আর গাছ কাটা হবে না। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গাছ কাটা শুরু হবে।
এর পাশাপাশি, এ দিন প্রবল বৃষ্টির কারণে শহরের বেশ কিছু রাস্তা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। ফিরহাদ জানান, আমপানের জেরে বালিগঞ্জ-সহ চার-পাঁচটি পাম্পিং স্টেশনে বিদ্যুৎ চলে যায়। তাই সে সব জায়গায় জল বার করতে পাম্প চালানো যায়নি। তিনি জানান, ঝড়ের দাপট কমলেই পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য ও পুর আধিকারিকেরা শহরের পরিস্থিতি দেখতে বেরোবেন। রাতে তাঁরা পুর ভবনেই থাকবেন বলে জানান।
এ দিকে, ঝড়ে ফাইবারের ছাদ উড়ে গিয়ে এ দিন পুরো জলমগ্ন হয়ে পড়ে কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানা। ভিজে যায় সব নথিপত্র। পুলিশকর্মীরা সকলেই ভিজে যান। খবর দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে। উড়ে যায় তিলজলা ট্র্যাফিক গার্ডের চালও। এ দিন ফিয়ার্স লেন ও কলুটোলা এলাকার অনেক বাসিন্দাকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ।
অন্য দিকে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পাঁচ নম্বর গেট সংলগ্ন নতুন ছাত্রাবাসের প্রধান গেট ঝড়ে ভেঙে রাস্তায় পড়ে যায় বলে খবর। ওই ছাত্রাবাসের পাঁচতলার পশ্চিম দিকের জানলা খুলে নীচে পড়ে যায়। লন্ডভন্ড এসএসকেএম চত্বরও। মেন বিল্ডিং, ট্রমা বিল্ডিং-সহ হাসপাতালের একাধিক বাড়ির কাচ ভেঙে ঘটে বিপত্তি। রোগীদের অন্যত্র সরানো হয়।