প্রতীকী ছবি।
স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের। মানবাধিকার কমিশনও এ ব্যাপারে একাধিক নির্দেশ দিয়েছে। তবু অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করতে অভিযুক্তদের ধরে পুলিশের মারধরের রেওয়াজ পাল্টায় না বলেই দাবি ভুক্তভোগীদের। সিঁথি থানার ঘটনার কথা শুনে তাঁদের বক্তব্য, কোনও কোনও ক্ষেত্রে এ সব প্রকাশ্যে এলে শোরগোল পড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ ঘটনাই থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে।
শহরের অপরাধ বিষয়ক আইনজীবীদের বড় অংশই বলছেন, ‘‘আইনকানুন ভাল ভাবে না জানলে বা ‘দাদা ধরা’ না থাকলে মারধর আরও বাড়ে।’’ আইনজীবী দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘২০১৩ সালে একটি চুরির ঘটনায় এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছিল আলিপুর থানা। আমি অভিযুক্তের আইনজীবী ছিলাম। হেফাজতে থাকাকালীন হঠাৎ এক দিন বলা হল, মাথায় চোট পাওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত ঘোষণা করা হয় ওই অভিযুক্তকে। পুলিশ ওঁকে পিটিয়েই মেরে ফেলেছিল। আমরা আদালতের দ্বারস্থ হলে শুনানির সময়ে পুলিশ দাবি করে, অন্য বন্দিদের সঙ্গে ঝামেলা করতে গিয়েই নাকি মাথায় চোটটা লেগেছিল!’’
দিব্যেন্দুবাবুর আরও দাবি, ‘‘২০১৭ সালে প্রতারণার মামলায় এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছিল লেক থানা। হেফাজতে নিয়ে অভিযুক্তকে পুলিশ এমন মেরেছিল যে, ওই ব্যক্তির শৌচকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। বিচারকের কাছে নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে ওই ব্যক্তির ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ দেখতে অনুরোধ জানিয়েছিলাম আমরা।’’ কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এমনও হয় যে, কাউকে হয়তো অভিযুক্ত সন্দেহে তুলে এনে একটি ঘরে বসিয়ে রাখা হল। এক জন গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুই করলেন কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে। কয়েক দফা মারধর এবং জিজ্ঞাসাবাদের পরে তিনি বেরিয়ে গেলেন। এর পরে অন্য এক পুলিশকর্মী এসেও একই ভাবে মারতে মারতে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। এবং ভাবলেন, তিনিই হয়তো প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছেন। ওই ব্যক্তি কত দফায় এই মার সহ্য করবেন?’’
এমন অভিজ্ঞতা তাঁরও হয়েছে বলে দাবি উল্টোডাঙার গুরুদাস দত্ত গার্ডেন লেনের এক বাসিন্দার। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ ছিল। সেই মামলা বিচারাধীন। কিন্তু ২০১২ সালে কয়েক দিন হাজতে কাটিয়ে ফেরার পর থেকেই পাড়ায় তাঁর নাম হয়ে গিয়েছে ‘টানাদা’! কারণ, এখন তাঁকে হাঁটতে হয় পা টেনে টেনে। তিনি বললেন, ‘‘প্রথমে পুলিশ এসে থানায় তুলে নিয়ে যায়। সেখানে জানতে চাওয়া হয়, আর কে কে ওই ঘটনায় জড়িত। অফিসার সেই সময়ে হাতের সামনে যা পেয়েছেন, তা দিয়েই মেরেছেন। এক দিন শীতের মধ্যে স্নান করিয়ে খালি গায়ে লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারা হল। ভেবেছিলাম, আর হাঁটতে পারব না। এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়।’’ তাঁর দাবি, ‘‘আমি দোষী কি না, সেটা আদালত বিচার করবে। ওরা ও রকম মারল কেন?’’
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘এর সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে রয়েছে, কাউকে সহজেই দোষী বলে ধরে নেওয়ার মানসিকতা। আর একটা ব্যাপার, চরম অপরাধীরও যে মানবাধিকার রয়েছে, সেটা সকলেই ভুলে যাই। আইনি ক্ষমতা হাতে থাকায় পুলিশ সেই ভুল আরও বেশি করে।’’
দিন কয়েক আগেই আবার প্রগতি ময়দান থানা এলাকার বাসন্তী হাইওয়ের পাশে খালে গাড়ি পড়ে মৃত্যু হয় দীপক রানা নামে এক কিশোরের। ঘটনার পরের দিন খালের পাঁক থেকে উদ্ধার হয় মৃতদেহ। গাড়িটি চালাচ্ছিল দীপক। সঙ্গে ছিল এক কিশোর এবং দুই কিশোরী। কী ঘটেছে জানতে বেঁচে ফেরা কিশোরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল থানার ওসি-র (বড়বাবু) ঘরে। স্রেফ জিজ্ঞাসাবাদই নয়, সেখানে ওই কিশোরকে ধরে ব্যাপক মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। এক পুলিশকর্মীকে আর এক পুলিশকর্মীর উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, ‘‘মার, লাথি মার দু’টো। এদের জন্য কাল আমাদের সরস্বতী পুজো বরবাদ হয়েছে। আরও জোরে মার।’’ লাগাতার লাথি, চড়-থাপ্পড়ের পরে ওই অধস্তন পুলিশকর্মী বলেন, ‘‘স্যর, হাত ধুতে হবে আমার। না হলে করোনাভাইরাস চলে আসবে আমার গায়ে।’’
প্রগতি ময়দান থানা কলকাতা পুলিশের পূর্ব ডিভিশনের অন্তর্গত। সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু অভিযোগ আসার অপেক্ষা করা হবে কেন? কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা ছুটিতে থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে না চাইলেও লালবাজারের এক কর্তা এ দিন বলেন, ‘‘সিঁথির ঘটনার পরে এই বিষয়গুলি নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা চলছে। নতুন করে থানাগুলির আচরণবিধি সংক্রান্ত কিছু নির্দেশিকা জারি করা হবে।’’