স্বপ্নভঙ্গ: (বাঁ দিক থেকে) পর পর ভারতের উইকেট পড়ায় হতাশ খুদে ক্রিকেটপ্রেমী। রাতের দিকে টিভির সামনে হাতে গোনা কয়েক জন। ম্যাচ হারার পরে মুখ ভার করে বসে ধামসা-মাদল বাজিয়েরা (ডান দিকে)। রবিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য ও স্বাতী চক্রবর্তী।
কারও পরিকল্পনা ছিল, ভারত জিতলেই তেরঙা পতাকা নিয়ে রাস্তায় ছুটবেন। কেউ ভেবে রেখেছিলেন, জয়ের আনন্দ উপভোগ করবেন ধামসা-মাদল বাজিয়ে। কেউ আবার জিতলেই পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ শুরু করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। পরের দিন হবে পাড়ায় মহাভোজ। কিন্তু পরিকল্পনা আর বাস্তবের রূপ পেল না।
৪৩ ওভারে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল যখন জয়ের রান নিতে দৌড়লেন, তখন হতাশা চেপে রাখতে পারলেন না ভবানীপুরের বাসিন্দা রঞ্জিত মিশ্র। রাস্তার ধারেই মঞ্চ বেঁধে বড় পর্দায় খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। সেই সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়ে বললেন, ‘‘কিছুই ভাল লাগছে না। ২০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনালের হারের বদলা নিতে পারলাম না আমরা। জিতলে কত কিছু ভেবে রাখা হয়েছিল।’’
পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা থেকে ধামসা মাদলের দল আনিয়েছিলেন রঞ্জিতরা। কথা ছিল, ভারত জিতলে ধামসা-মাদল বাজবে রাতভর। ধামসার সামনে মুখ ভার করে বসেছিলেন বাদক সন্ন্যাসী মুর্মু, সুবল হেমব্রমরা। সন্ন্যাসী বলেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়ার যখন তিনটে উইকেট পড়ে গেল, তখন ধামসা বাজানো শুরু হয়েছিল। সেই বাদ্যি শুনে পাড়ার সবাই জড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরে তো আস্তে আস্তে খেলাটাই ঘুরে গেল।’’
টালিগঞ্জ এলাকার একটি ক্লাবের সদস্য কিংশুক বসু জানান, ভারত জিতবে ধরে নিয়েই সোমবার তাঁদের পাড়ায় খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছিল। কেটারিং সংস্থাকে বরাতও দেওয়া হয়েছিল। এখন সব বাতিল হচ্ছে। কিংশুক বলেন, ‘‘আজ প্রথম থেকেই ভারতের ব্যাটিং খারাপ হওয়ায় মনে মেঘ জমছিল। কিন্তু, যখন প্রথম সাত ওভারে অস্ট্রেলিয়ার তিনটে উইকেট পড়ে গেল, তখন মনে হল যেন মেঘ কেটে সূর্য উঠছে। কিন্তু সেই সূর্য আবার মেঘে ঢাকা পড়ে গেল।’’
অথচ দিনটা শুরু হয়েছিল অন্য রকম ভাবে। গত দু’দিন ধরে যে উন্মাদনার ছবি দেখা গিয়েছিল শহরে, রবিবার সকাল থেকে তা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। উল্টোডাঙা, পাটুলি, শোভাবাজার, টালিগঞ্জ, যাদবপুর, বাঘা যতীন— সর্বত্রই ছিল উৎসবের মেজাজ। কোথাও সকাল থেকে যজ্ঞ করা শুরু হয়েছিল, কোথাও খেলা শুরুর আগে জাতীয় পতাকা, তাসা-সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শোভাযাত্রা। বিরাট, রোহিত, মহম্মদ শামির বিশাল কাট-আউট নিয়ে সকাল থেকে যজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল টালিগঞ্জ এলাকায়। চলছিল বক্স বাজিয়ে গানবাজনাও। উন্মাদনার এমনই ছবি আহিরীটোলাতেও দেখা গিয়েছিল। গোটা এলাকা জাতীয় পতাকা দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছিল সেখানে। সাজানো হয়েছিল রং-বেরঙের বেলুনেও।
সকালের দিকে রাস্তায় কিছু গাড়ি দেখা গেলেও বেলা গড়াতেই অঘোষিত বন্ধের চেহারা নেয় শহর। যে দু’-একটি বাস রাস্তায় চলতে দেখা গিয়েছিল, তা-ও ছিল ফাঁকা। তবে এর বিপরীত ছবি দেখা গিয়েছিল বিশ্বকাপের ফাইনালের জন্য বিশেষ আয়োজন করা কয়েকটি শপিং মলে। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের একটি শপিং মলে গিয়ে দেখা যায়, ম্যাচ শুরুর আগেই খেলা দেখার জন্য ভারতের জার্সি পরে লম্বা লাইন কমবয়সিদের। খেলা দেখতে আসা এক তরুণী যুক্তা ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘২০১১ সালে যখন জিতেছিলাম, তখন ছোট ছিলাম। ঠিক মতো বুঝতাম না। বন্ধুরা মিলে তাই চলে এলাম। খেলার শেষ পর্যন্ত এখানেই থাকব।’’ শহরের একাধিক প্রেক্ষাগৃহেও এ দিন টিকিট কেটে খেলা দেখার ব্যবস্থা ছিল।
তবে ট্রাভিস হেড আর লাবুশানের লম্বা ইনিংসের সময় থেকেই প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ওই শপিং মল কিংবা শহরের প্রেক্ষাগৃহ ফাঁকা হতে শুরু করে। আহিরীটোলার যে ক্লাবকে পতাকা দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছিল, সাড়ে আটটা থেকে তাদের সামনের চেয়ার ফাঁকা হতে শুরু করে। সেখানেই বসেছিলেন কলেজপড়ুয়া কৌশিক সরকার। হতাশ গলায় কৌশিক বলেন, ‘‘সারা টুর্নামেন্ট এত ভাল খেলে শেষ পর্যন্ত ফাইনালেই হারতে হল! এটা তো সারা বছর পড়াশোনা করে ক্লাসের পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েও ফাইনালে খারাপ ফল হল!’’ কৌশিকের পাশে দাঁড়ানো এক প্রৌঢ় অজয় সামন্ত বলেন, ‘‘কপিলের ’৮৩ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালেও ভারতের রান কম ছিল। সেখান থেকে জিতেছিল ভারত। এ বার ভারতের রান কম দেখে সে রকম আশায় বুক বেঁধেছিলাম।’’
ওই ক্লাবের খুব কাছেই কার্তিক পুজোর মেলা বসেছে। ক্লাবে যেখানে খেলা দেখানো হচ্ছিল, তার কাছেই মেলায় বিক্রি হচ্ছিল গজা, জিলিপি। দোকানদার তরুণ ঘোষ বলেন, ‘‘ক্লাব থেকেও বলেছিল, জিতলেই পাড়ায় জিলিপি খাওয়ানো হবে। বেশি করে তাই জিলিপি ভাজতে। সেই জিলিপি তো পড়েই রইল।’’ শোভাবাজার এলাকার এক যুবক বলেন, ‘‘বিসর্জনের দুঃখ আজ হচ্ছে। আবার সেই চার বছরের অপেক্ষা।’’
রাজারহাট চৌমাথা এলাকার একটি আবাসনের ছাদে এলইডি পর্দায় খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন আবাসিকেরা। খেলা শেষ হলে আবাসনের ছাদে কব্জি ডুবিয়ে মটন বিরিয়ানি খাওয়ার কথা ছিল। সকাল থেকে উৎসাহ নিয়ে মহিলা বাসিন্দারাই বিরিয়ানি রান্নার আয়োজন করেছিলেন। বাসিন্দা মেহেন্দি হাসান বলেন, ‘‘রান্না তো হয়েই গিয়েছিল। তাই দুঃখ নিয়েও বিরিয়ানি খেতে হচ্ছে। এত মন খারাপ নিয়ে বিরিয়ানি কোনও দিন খাইনি।’’
ঠিক যেমন, ভারতের হার সত্ত্বেও বাতাস ভারী করে বাজির আওয়াজ শোনা গেল শহরে। দেশ জিতবে ধরে নিয়েই দেদার বাজি কিনে রেখেছিলেন অনেকে। এত দুঃখ নিয়েও যে বাজি ফাটানো যায়, সেই অভিজ্ঞতা হল আজ এই শহরের।