বেআইনি: লরি থেকে পুলিশের হাতে কিছু গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা। মঙ্গলবার রাতে, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে। নিজস্ব চিত্র
মঙ্গলবারের গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটা ২টো ছুঁইছুঁই।খাঁ খাঁ করছে জনপ্রাণীশূন্য কাঁকুড়গাছি মোড়। অদূরে ট্র্যাফিক পুলিশের কিয়স্কে আলো জ্বললেও ভিতরে কেউ রয়েছেন কি না, বোঝা গেল না। কিয়স্কের উপরেই জ্বলছে লাল সিগন্যাল। কিন্তু নির্জন রাতে সেই সিগন্যাল উপেক্ষা করেই বেরিয়ে যাচ্ছে ট্রাক, ছোট লরি।
কয়েক ঘণ্টা আগে একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল বি টি রোডে। চিড়িয়ামোড় ছেড়ে ডান দিকে যেতেই চোখে পড়ল লরি, ট্রাক ও গাড়ির বেপরোয়া দৌড়। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দেখা গেল, লাল আলোর নিষেধ না মেনে উত্তর শহরতলির দিকে ছুটে যাচ্ছে লরি।
সোমবার কাকভোরে মানিকতলার কাছে লোহাপট্টি এলাকায় বেপরোয়া গতিতে আসা একটি লরি ধাক্কা মেরেছিল সিমেন্টের বাসগুমটিতে। সেই দুর্ঘটনায় দু’জনের মৃত্যু হয়। দু’জন গুরুতর আহত হন। সেই সূত্রেই বেরোনো হয়েছিল রাতের শহরে বেপরোয়া লরির চলাচল দেখতে।
আরও পড়ুন: ‘আমার গোপালকে কেড়েছে বাজি, এর বিক্রি নিষিদ্ধ হোক’
আরও পড়ুন: অভিনেতাকে দেখতে ‘পালাল’ কিশোরী, পরে উদ্ধার
যুক্তি, ‘ভয়’। সেই ভয় কখনও সময়মতো মাল খালাসের, কখনও আবার টাকার সন্ধানে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পুলিশ, পরিবহণ দফতর বা অন্য কোনও সরকারি দফতরের লোকজনের। তবে তাঁরা জানান, টাকা তোলার এই উপদ্রব বেশি শহরের বাইরে। আর এ সবের থেকে বাঁচতেই অনেক সময়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটান তাঁরা।
তাঁদের এই অভিযোগ যে অমূলক নয়, তা বোঝা গেল বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতেই। বছর চারেক আগে এই রাস্তায় একটি লরি বেপরোয়া গতিতে ছুটতে গিয়ে পিষে দিয়েছিল চারটি শিশুকে। ওই ঘটনার পরে দমদম থানার দু’টি গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল জনতা। অভিযোগ উঠেছিল, টাকার জন্য পুলিশের গাড়ি লরিটিকে তাড়া করেছিল। পালাতে গিয়ে লরিটি ওই দুর্ঘটনা ঘটায়।
মঙ্গলবার রাতে দেখা গেল, পরিস্থিতি সেই তিমিরেই রয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ের উপরে পুলিশের গাড়ি টর্চ জ্বেলে লরি থামানোর চেষ্টা করছে। কোনও কোনও লরি থেকে পুলিশের হাতে কিছু গুঁজে দেওয়া হচ্ছে, কোনও লরি আবার জোরে পুলিশের গাড়ি টপকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার অন্য ধারে ট্রাক দাঁড় করিয়ে সময়ের অপেক্ষা করছেন ট্রাকচালক কালু মণ্ডল, আফজ়ল মোল্লারা। কিসের সময়?
আফজ়ল বললেন, ‘‘রাস্তায় এখন পুলিশের গাড়ি ঘুরছে। ধরলে ওভারলোড থেকে শুরু করে নানা ছলে ফাইন করবে। মোটা টাকা চাইবে। আমাদেরও লোকজন রয়েছে শহরে। অফিসারদের গাড়ি চলে গেলে খবর আসবে। তখন শহরে ঢুকব।’’ একই কথা জানালেন ঝাড়খণ্ড থেকে মালপত্র বোঝাই করে বনগাঁর উদ্দেশে আসা কালু মণ্ডল। তাঁর অভিযোগ, ‘‘টাকা দিতে না পারলে মারধর তো রয়েছেই। গাড়িও আটকে রাখা হবে। আমরা অনেক সময়ে জোরে গাড়ি চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে বাধ্য হই।’’
শেষ রাতের গন্তব্য ছিল বন্দর এলাকার তারাতলা, হাইড রোড। তারাতলা মোড়ে দেখা গেল, পাতি ভেঙে কাত হয়ে রয়েছে বালি-বোঝাই দৈত্যাকৃতির ট্রাক। সেখানে সাহায্য করতে আসা এক ব্যক্তির কথায়, ‘‘শহরে চলাচলের সময়ে ১০, ২০ টাকা ছুড়ে দিলেই চলে। কারণ এই সব গাড়ির সঙ্গে অন্য রকম বোঝাপড়া থাকে। এরা যে কোনও জায়গায় দাঁড়ালেও কেউ কিছু বলবে না। যাদের ‘সেটিং’ নেই, তারাই পুলিশ দেখে দৌড়য়।’’
পুলিশ কিংবা পরিবহণ দফতরের তরফে অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তাদের পাল্টা দাবি, চালকেরা দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানোর পরে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অনেকে নেশা করেও গাড়ি চালান। তার জেরেই
দুর্ঘটনা ঘটে।
‘ফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর দাবি, ‘‘এক জন চালককে নানা দুশ্চিন্তা নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। তিনি মানসিক ও শারীরিক ভাবে অবসন্ন হয়ে পড়েন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ওভারলোডিং-এ ছাড় নিয়ে সর্বত্র যে নিয়ম রয়েছে, এ রাজ্যেই তার ব্যতিক্রম। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতেই অনেকে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছেন।’’