অভিন্ন: কন্টেনমেন্ট জ়োনের বাইরে থাকা শিয়ালদহের কোলে মার্কেটে মানুষের ভিড়। বুধবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
আনলক ২-এর পরে ফের শুরু লকডাউন! যা শুরু হতে চলেছে আজ বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটা থেকে। তার আগে বুধবার, নতুন করে ঘোষণা হওয়া শহরের ২৫টি কন্টেনমেন্ট জ়োন ঘুরে দেখা গেল উদাসীনতার পুরনো ছবিই। এ দিন রাত পর্যন্ত গার্ডরেল দিয়ে ঘিরে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়নি বহু জ়োন। যেখানে গার্ডরেল পড়েছে, সেখানেও চলছে প্রথম দফার লকডাউনের মতোই ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’!
কন্টেনমেন্ট জ়োনে প্রবেশ বা বেরোনো বন্ধ করা তো দূর, গার্ডরেল এক দিকে সরিয়ে রেখে বা তার ফাঁক গলেই চলছে অবাধ যাতায়াত। আশপাশে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও এখনও মাস্ক পরার অনীহা স্পষ্ট অনেকের মধ্যেই। কোথাও করোনা আক্রান্তের বাড়ির কাছের ফুটপাতে দল বেঁধে চলছে দেদার তাস খেলা! কোথাও আবার ফেরিওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে চলছে আইসক্রিম খাওয়া। তেমনই এক আইসক্রিম ক্রেতা বললেন, ‘‘আগামী সাত দিনের বাজার সকাল সকাল সেরে ফেলেছি। লকডাউন কী, আগের বারই দেখেছি। তাই চিন্তা নেই।’’ আইসক্রিম বিক্রেতাকে দেখিয়ে এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘করোনা আইসক্রিম বলে চেঁচাচ্ছিলেন। সেটা কী দেখতে এসেছিলাম। কিনে ফেলেছি।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিনই পুলিশের এক অনুষ্ঠান থেকে লকডাউনের নিয়মবিধি মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছেন। কিন্তু সেই বোঝানোয় কাজ হবে কি না, প্রশ্ন তুলে দিয়েছে শহরের কন্টেনমেন্ট জ়োনগুলির দিনভরের চিত্র।
দক্ষিণ কলকাতার আলিপুর রোডে একসঙ্গে পঞ্চাশেরও বেশি করোনা আক্রান্তের হদিস মেলার পরে যে আবাসন ঘিরে চলতি সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি শোরগোল পড়েছে, সেখানে গিয়েও এ দিন দেখা গেল, পুলিশের গার্ডরেল সরিয়েই দেদার যাতায়াত করছেন আবাসনের বাসিন্দারাই! আবাসনের তেমনই এক জনের কথায়, ‘‘আগের মতোই মানুষের হাবভাব থাকলে এই লকডাউনেও কিছু লাভ হবে না।’’ তবে তিনি বেরিয়েছেন কেন? একমুখে হেসে উত্তর দিতে চাননি অবশ্য ওই বাসিন্দা। ওই আবাসনের কাছের একটি ওষুধের দোকানে মাস্ক ছাড়াই হাজির স্নেহময় গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক ক্রেতার বক্তব্য, ‘‘আমরা বহুতলে থাকি না। তাই ভয় নেই। লকডাউন শুধু ওঁদের জন্য।’’
দুপুরে মুদির দোকানে ভিড় করা বেলভেডিয়ার রোডের কন্টেনমেন্ট জ়োনের বাসিন্দা তমালিকা দত্তবণিকের আবার দাবি, ‘‘বদনাম করতে পাড়ার নাম লকডাউন তালিকায় ফেলা হয়েছে। বহু এলাকায় করোনা রোগী থাকলেও সে সব কিন্তু ওই তালিকার বাইরে রয়েছে।’’ একই দাবি, সুইনহো লেনে তাস খেলায় ব্যস্ত এক মধ্যবয়সির। তাঁর মন্তব্য, ‘‘করোনা হলে এমনিই সেরে যাচ্ছে। লকডাউন করা হয়েছে অন্য কারণে।’’ কী কারণ? বলতে পারেননি ওই ব্যক্তি।
‘করোনা জয়ের’ একই হাবভাব উত্তর কলকাতার সুরেন সরকার রোড, উল্টোডাঙা মেন রোড, গিরিশ পার্কের বলরাম দে স্ট্রিট, বেলেঘাটার চাউলপট্টি রোডে। চাউলপট্টি রোডের একটি কলে বিকেলের জল নিতে ভিড় করা মহিলাদের অনেকের মুখেই মাস্ক ছিল না। অথচ, ওই এলাকা থেকেই গত কয়েক দিনে অন্তত ২৪ জন করোনা আক্রান্তের হদিস মিলেছে। এক মহিলার উত্তর, ‘‘লকডাউনে করোনা যাবে না। করোনা আটকানো যাবে শুধু ইমিউনিটি থাকলে।’’ পাশে দাঁড়ানো অন্য এক মহিলার দাবি, ‘‘আমাদের পাড়ায় একটি কলের উপরে অন্তত ১৬-১৭ ঘর লোক নির্ভরশীল। লকডাউন কি অত জনকে একসঙ্গে কলে আসা বন্ধ করতে পারবে?’’
কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা অবশ্য এ দিনও বলেছেন, ‘‘কন্টেনমেন্ট জ়োনে লকডাউনের সব নিয়ম কার্যকর করতে থানাগুলিকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মাস্ক না পরলে আগের মতোই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ কলকাতা পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিমও বললেন, ‘‘মানুষের জন্যই যে এই লকডাউন, সেটা সকলে বুঝুন।’’
সেই বোঝার ছোট্ট নমুনা দেখা গেল এ দিন বিকেলে উল্টোডাঙার অধরচন্দ্র দাস লেনে। ওই কন্টেনমেন্ট জ়োন থেকে ধোপদুরস্ত পোশাকে সন্তান কোলে বেরোনোর মুখে এক দম্পতি বললেন, ‘‘আগামী সাত দিন কোথাও যেতে পারব কি না, জানি না। তাই একটু শপিং মলে ঘুরতে যাচ্ছি।’’