ঘরে ফেরা: ভেলোর থেকে যাত্রীদের নিয়ে আসা ট্রেনের জানলা দিয়ে আপনজনদের দেখে উচ্ছ্বাস শিশুর। মঙ্গলবার, হাওড়ায়। ছবি: সুমন বল্লভ
তামিলনাড়ুর ভেলোর থেকে বিশেষ ট্রেনের হাওড়ায় পৌঁছনোর কথা ছিল দুপুর দেড়টার মধ্যে। মঙ্গলবার যখন হাওড়ার নিউ কমপ্লেক্সের ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে সেই ট্রেন এসে পৌঁছল, তখন বিকেল ৫টা। অন্য দিকে, পুরনো কমপ্লেক্সের ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ঠিক তার দশ মিনিট পরেই ছেড়ে গেল দিল্লি-হাওড়া বিশেষ যাত্রিবাহী ট্রেন। প্রায় দু’মাস পরে বন্দিদশা কাটতে চলায় তখন দু’জায়গাতেই হাসি-কান্নার ছবি।
গত ২২ মার্চ শেষ যাত্রিবাহী ট্রেন চলে যাওয়ার পরে এ দিনই প্রথম ট্রেন আসবে বলে ঘোষণা হয়েছিল শনিবার। রেলের তরফে জানানো হয়েছিল, ভেলোর থেকে ১১২৬ জন যাত্রীকে নিয়ে ট্রেনটি আসছে। ওই ট্রেনে মূলত ভেলোরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আটকে পড়া যাত্রীরা ছাড়াও থাকবেন কিছু শ্রমিক ও পড়ুয়া। একই সঙ্গে হাওড়া থেকে রাজধানীর মতো বিশেষ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ট্রেনে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেবেন এ রাজ্যে আটকে পড়া ভিন্ রাজ্যের লোকজন।
লকডাউনের মধ্যেও এই দু’টি বিশেষ ট্রেন নিয়ে এ দিন রেল দফতর ও রাজ্য সরকারের প্রস্তুতি ছিল চোখে পড়ার মতো। পুরনো ও নতুন কমপ্লেক্সের ৯ এবং ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম-সহ গোটা স্টেশন চত্বর বার বার স্যানিটাইজ় করা হয়েছে। ভেলোর থেকে আসা যাত্রীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আলাদা রিসেপশন ডেস্কের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যাত্রীরা স্টেশনে পৌঁছনো মাত্রই ব্যবস্থা করা হয় সকলের থার্মাল স্ক্রিনিং-এর। প্রতিটি রিসেপশন ডেস্কে হাওড়া জেলা প্রশাসনের তরফে একটি ফোল্ডারে হোম কোয়রান্টিনে থাকার নিয়মাবলী-সহ এক পাতা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এবং এক বাক্স খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যেক যাত্রীকে নিজেদের জেলায় পৌঁছে দিতে রাখা হয়েছিল ৭১টি বাস। বাসচালক ও কন্ডাক্টরদের নিরাপত্তার জন্য দেওয়া হয়েছিল পিপিই।
নজর-বন্দি: নয়াদিল্লিগামী ট্রেনে সওয়ার হতে হাওড়া স্টেশনে ঢোকার লাইন। মঙ্গলবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে বিকেল ৫টায় নতুন কমপ্লেক্সের ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পশ্চিম প্রান্তের বাঁকে ভেলোর থেকে আসা ট্রেনের ইঞ্জিন দেখা যেতেই প্ল্যাটফর্ম জুড়ে তৎপরতা বেড়ে যায়। যাত্রীদের স্বাগত জানাতে প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছন রাজ্যের সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায়, হাওড়ার ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার ইশাক খান, রেল পুলিশ সুপার কে কান্নন-সহ রেল পুলিশের পদস্থ কর্তারা।
আরও পড়ুন: এত রকমের ছাড়েই শিকেয় লকডাউন, ক্ষুব্ধ পুলিশমহল
ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ফেলেন আসানসোলের বাসিন্দা, বছর পঞ্চান্নর বিদ্যা মণ্ডল। গত ১ মার্চ ভেলোরে গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। লকডাউন হয়ে যাওয়ায় আর ফিরতে পারেননি।
কেমন ছিলেন সেখানে? প্রশ্ন করতেই কেঁদে ফেলেন প্রৌঢ়া। বলেন, ‘‘আমরা কী কষ্টে যে ছিলাম, বলে বোঝাতে পারব না। খাওয়াও জুটত না ঠিকমতো। বাড়ি ফিরতে পেরে বাঁচলাম!’’
মায়ের মস্তিষ্কের টিউমার অস্ত্রোপচারের পরে ধরা পড়ে, সেটি ক্যানসার। মার্চের গোড়ায় মাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ভেলোরে গিয়ে আটকে যান নদিয়ার ঈশান মহন্ত। অসুস্থ মা ঋতা মহন্তকে নিয়ে নামতেই রেলের তরফে হুইলচেয়ারে করে মহিলাকে পৌঁছে দেওয়া হয় নদিয়াগামী বাসে।
আরও পড়ুন: এগিয়ে যাওয়ার মানচিত্র জুড়ে থাকুক জনস্বাস্থ্য ও গ্রামীণ স্বাস্থ্য
ঈশান বলেন, ‘‘ট্রেনে ব্যবস্থা খুব ভাল ছিল। খাবারদাবার সময় মতো পেয়েছি। রাজ্য সরকারও সব রকম সাহায্য করেছে। সব থেকে ভাল লাগছে মাকে নিয়ে ফিরতে পেরে।’’
প্রায় একই অভিজ্ঞতা অন্য যাত্রীদেরও। মায়ের চিকিৎসার জন্য ভেলোরে গিয়ে দেড় মাস আটকে ছিলেন গড়িয়ার বাসিন্দা স্মৃতি রায়। তিনি বলেন, ‘‘তামিলনাড়ু প্রশাসন আমাদের ফিরতে সাহায্য যেমন করেছে, তেমনই রেল ও রাজ্য সরকারও যে ব্যবস্থা করেছে, তাতে আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ।’’
ভেলোরে চিকিৎসা করাতে যাওয়া রোগীরা ছাড়াও এ দিন ওই বিশেষ ট্রেনে কয়েক জন শ্রমিক ফিরেছেন। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়ি ফেরা যাত্রীদের মধ্যে প্রায় ৫০০ জনই পশ্চিম বর্ধমান জেলার বাসিন্দা।