প্রতীকী ছবি
চিকিৎসকেরা বলেন, ‘‘আমরা কান বেচে খাই।’’ স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে শুনতে হয় ফুসফুস কী বলছে! রোগীর শরীরের ভিতরের পরিস্থিতি কান পেতে শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আসে হাত দিয়ে দেখে অনুভব করা। এর পরে রোগ নির্ণয় করে শুরু হয় চিকিৎসা।
কিন্তু করোনা অতিমারির এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসাশাস্ত্রের সেই মৌলিক ‘ক্লিনিক্যাল এগজামিনেশন’ পদ্ধতি কি বদলে যেতে চলেছে? কারণ, সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীদের ছুঁয়ে দেখা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। ফলে বহু চিকিৎসককে বাড়িতে বসে অনলাইনে ‘ক্লিনিক্যাল এগজামিনেশন’ শুরু করতে হয়েছে। যেখানে কথা হচ্ছে ভিডিয়ো কল বা ফোনে। প্রেসক্রিপশনও লিখতে হচ্ছে অনলাইনে। সেই ই-প্রেসক্রিপশন দেখিয়েই ওষুধ কিনছেন রোগীরা। রোগীর ‘কেস হিস্ট্রি’ও লেখা থাকছে অনলাইন ডায়েরিতে। রক্তের নমুনা বা অন্য পরীক্ষার রিপোর্টও চিকিৎসকেরা চেয়ে নিচ্ছেন ইমেল বা হোয়াটসঅ্যাপে।
যদিও বুধবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, লকডাউনের নিয়ম মেনে চেম্বার খুলতে পারবেন চিকিৎসকেরা। তবে এই পরিস্থিতিতে রোগীরা চাইলেই চিকিৎসকের কাছে পৌঁছতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে। ফলে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশেরই এখন ভরসা ‘অনলাইন ক্লিনিক্যাল এগজামিনেশন’।
আরও পড়ুন: কন্টেনমেন্ট জ়োনেও চলছে আড্ডা-তাস
মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলেন, ‘‘বেশির ভাগ সময়ই এখন কাটছে মেডিক্যাল কলেজের কাজে। কিন্তু বহু রোগী প্রতিদিন ফোন করছেন। এই সময়ে সামনাসামনি তাঁদের দেখা সমস্যা তো বটেই। অনেকেই আসতে পারছেন না। তাঁদের কথা মোবাইলে শুনে নিচ্ছি। ওষুধও ফোনে বলতে হচ্ছে। অসুবিধা হলে বলছি, ওষুধের দোকানে গিয়ে আমাকে ফোন করতে। ডায়াবিটিস বা হাইপারটেনশনের রোগীদের তো অকারণে অপেক্ষা করিয়ে রাখা ঠিক নয়।’’ অরুণাংশুবাবু জানান, তাঁর স্ত্রী পায়েল তালুকদার সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ চিকিৎসক। তিনিও অনলাইনে রোগীদের সঙ্গে কথা বলছেন। মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম আবার বললেন, ‘‘আমার মতে অনলাইনে রোগী দেখাই ভবিষ্যতের অন্যতম পথ হতে পারে। আমি নিজেই ভিডিয়ো কলে রোজ ১৩-১৪ জনকে দেখছি। সেখানেই ই-প্রেসক্রিপশন দিচ্ছি। কেস হিস্ট্রি লিখে রাখারও জায়গা রয়েছে। প্রয়োজনে একই পরিবারের অনেকেও কথা বলে নিতে পারেন।’’
কিন্তু চিকিৎসকদের আর একটি অংশের বক্তব্য, ‘‘রোগীকে সামনাসামনি দেখার বিকল্প কিছু হয় না। অনলাইনে রোগী দেখা কখনওই স্থায়ী হতে পারে না। এই পরিস্থিতি মিটে গেলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’’ ফিজিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক যেমন জানালেন, অনলাইনে রিপোর্ট চেয়ে নিয়ে দেখার পাশাপাশি দূর থেকে ‘টেলিমেডিসিন’ ব্যবস্থায় রোগী দেখা শুরু করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনিও বলছেন, ‘‘এখন তো আর কিছু করারও নেই। কম সংখ্যক হলেও সামনাসামনি রোগী দেখার চেষ্টা করছি।’’ মেডিসিনের আর এক চিকিৎসক অরিজিৎ রায়চৌধুরী আবার টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে রোগী দেখার পক্ষপাতী নন। তাঁর কথায়, ‘‘কম হলেও আমি সামনাসামনিই রোগী দেখছি। আর ফোনে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছি। টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে কিছু আইনি জটিলতা রয়েছে। রোগী চাইলে ঠিক আছে, কিন্তু কোনও চিকিৎসক রোগীকে এই পদ্ধতিতে কথা বলতে বাধ্য করতে পারেন না। তা ছাড়া অনলাইনে সব রেকর্ড রাখতে হয়। রোগীর গোপনীয়তা এর মাধ্যমে লঙ্ঘিত হতে পারে। কাকে কোন ওষুধ দেওয়া যাবে, তারও নিয়ম রয়েছে। ফলে সামনাসামনি বা খুব দরকার হলে ফোনে কথা বলাই ভাল।’’ অরুণাংশুবাবুরও বক্তব্য, ‘‘যে ওষুধ চলছে, সেটাই চলবে কি না জেনে নিতেও রোগীকে টাকা দিতে হয় টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে। যা এই আর্থিক অনটনের পরিস্থিতিতে একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।’’
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় আবার জানালেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁকেও ভিডিয়ো কলে রোগী দেখতে হয়েছে। তবে বিষয়টি তাঁর পছন্দের নয়। সুবীরবাবু বলেন, ‘‘এমনিতেই ক্যানসার নিয়ে রোগীর চেয়ে তাঁর বাড়ির লোকই বেশি কথা বলেন। রোগীকে তাঁরা সামনেই আনতে চান না। মনে করা হয়, ক্যানসারের কথা রোগী নিতে পারবেন না। ভিডিয়ো কলে রোগী দেখতে গিয়ে দেখেছি, তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। যা বলার, বললেন তাঁর বাড়ির লোক। এ ভাবে রোগী দেখে লাভ কী? তার চেয়ে ফোনে কথা বলা ভাল।’’ একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘‘অভিজ্ঞতায় দেখেছি, রোগ নিয়ে পরিবারের লোকের সঙ্গে কথা হয়ে গেলে রোগীকে ফোনটা দিতে বললে ঠিক দেওয়া হয়। সেটা ভিডিয়ো কলের ক্ষেত্রে হয় না। তাই আমি এখন কথার ফাঁকে বলি, রোগীকে একটু দিন তো। কথা বলি!’’
দূর থেকে অনলাইনে বা ফোনের মাধ্যমে চিকিৎসাতেও এ যেন রোগীকে প্রকারান্তরে ছুঁয়ে দেখারই চেষ্টা।
আরও পড়ুন: নিয়মের রকমফেরে ধোঁয়াশা লক্ষ্মণরেখায় বন্দি শহরে
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)