নেই খাবার। মিলছে না বাস। শনিবার হাওড়া স্টেশনের বাইরে বিক্ষোভ রাজ্যে ফেরা শ্রমিকদের। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
স্টেশন চত্বরে কোনও গাড়ি এলেই ওঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন সেটির উপরে। কেউ হাতজোড় করে খাবার চাইছিলেন। কেউ বা পাঁচ-দশ টাকা ভিক্ষা। কেউ চিৎকার করে বলছিলেন, ‘‘দু’দিন কিছু খাইনি। খাবার দিন। বাচ্চাটা জল চাইছে। অন্তত জলের ব্যবস্থাটা করে দিন।’’ কিন্তু খাবার কোথায়? জলই বা কোথায়? পুলিশ উদ্যোগী হওয়ার চার ঘণ্টা বাদে জলের কিছু পাউচ ও বিস্কুট এল বটে, কিন্তু তখন বুভুক্ষু মানুষগুলো বাড়ি ফেরার বাসের জন্য এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
শনিবার সকালে এটাই ছিল হাওড়া স্টেশনের বাইরের ছবি। গোয়া থেকে তেরোশোরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিককে নিয়ে যাত্রা করার ৫২ ঘণ্টা পরে এ দিন ভোর ৫টা নাগাদ একটি বিশেষ ট্রেন এসে পৌঁছয় হাওড়ার নয়া কমপ্লেক্সে। যাত্রীরা সকলেই উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। তাই ট্রেনটি উত্তরবঙ্গে না গিয়ে কেন হাওড়ায় এল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শ্রমিকেরা।
তাঁদের অভিযোগ, ওই ট্রেনে শেষ বার পেট ভরানো খাবার তাঁরা পেয়েছিলেন ২৮ তারিখ দুপুরে। তার পরে শুধু দু’প্যাকেট বিস্কুট আর দু’লিটার জল। শিশুদের মুখেও দিতে পারেননি কিছু। ট্রেনেও আসতে হয়েছে গাদাগাদি করে বসে। তাঁদের অভিযোগ, ট্রেন থেকে নামার পরেই থার্মাল পরীক্ষা করে স্টেশনের বাইরে বার করে দেওয়া হয় সবাইকে। বাড়ি ফেরার বাস ও খাবার না পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শ্রমিকেরা। তাঁদের বিক্ষোভে পুলিশকেও পিছু হটতে হয়। পরে পুলিশকর্তারা এসে পানীয় জল, বিস্কুটের প্যাকেট এবং বাসের ব্যবস্থা করতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এ দিন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখা যায়, শয়ে শয়ে শ্রমিক ভিড় করেছেন বাইরে। কেউ খাবারের জন্য চিৎকার করছেন। কেউ বা বাস না-পেয়ে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন পুলিশকর্মীদের কাছে। ওই সময়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খাবারের প্যাকেট নিয়ে ঢুকতেই তাদের গাড়ির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন কয়েকশো শ্রমিক। এত মানুষ দেখে পালিয়ে যান ওই সংস্থার লোকজন।
সাত ও পাঁচ বছরের দুই সন্তানকে নিয়ে পার্কিং লটের সামনে অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় বসে ছিলেন মালদহের ফিরদৌসি বিবি। বললেন, ‘‘বাচ্চারাও দু’দিন কিছু খায়নি। ট্রেনে দু’প্যাকেট করে বিস্কুট ও এক বোতল জল দিয়েছিল। তাই খেয়ে ওরা আছে। খিদের জ্বালায় কেঁদে উঠছে।’’
দক্ষিণ দিনাজপুরের মঞ্জু মোল্লা জানান, স্টেশনে ঢোকার পরেই তাঁদের জানানো হয়, উত্তরবঙ্গের বাস মিলবে। তিনি বলেন, ‘‘দীর্ঘ অপেক্ষার পরে বাস পেলাম। কিন্তু সেটা বহরমপুর পর্যন্ত যাবে। এর পরে কী করে বাড়ি ফিরব, জানি না।’’
রেল সূত্রের খবর, ট্রেনটি ছেড়েছিল ২৭ তারিখ রাত ১টায়। অভিযোগ, এ দিন হাওড়ায় ওই ট্রেন পৌঁছনোর পরে কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। সকাল ১০টার পরে জল-বিস্কুট নিয়ে আসে পুলিশ। তারও পরে বাসের ব্যবস্থা হয়।
খাবার বা বাসের ব্যবস্থা ছিল না কেন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘ট্রেনগুলি ঠিক কখন কোথায় ঢুকবে, তা নিয়ে আমাদের কাছে ঠিকঠাক খবর ছিল না। রেলও কিছু জানায়নি।’’
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ অফিসার সঞ্জয় ঘোষ বলেন, ‘‘শুক্রবার রাতেও চক্রধরপুর স্টেশনে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকেরা যে অভিযোগ করছেন, তা ঠিক নয়। রেল প্রতিটি ট্রেনকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে।’’
পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, ওই ট্রেনের আগাম কোনও খবর জেলা প্রশাসন দেয়নি। যে সব ট্রেনে উত্তরবঙ্গের যাত্রী বেশি, সেগুলিকে নিউ জলপাইগুড়ি পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু এই ট্রেনটি কেন হাওড়ায় থেমে গেল, তা জানেন না পরিবহণ আধিকারিকেরা। পরে খবর পেয়ে রাজ্য পরিবহণ নিগমের পাঁচটি এবং উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের চারটি বাসে যাত্রীদের বহরমপুর পৌঁছনো হয়। বহরমপুরে স্থানীয় যাত্রীদের নামিয়ে সেখান থেকে অন্য কিছু বাসে উত্তরবঙ্গে পাঠানো হয় বাকি যাত্রীদের।