লকডাউনের পরের দিনই চাঁদনি চকে মানুষের ভিড়। -নিজস্ব চিত্র
লকডাউন উঠতেই বাজার-রাস্তাঘাটে ফিরল সেই চেনা ভিড়। মুখে মাস্ক নেই। দূরত্ব-বিধি শিকেয় তুলে চলছে কেনাকাটা! শুক্রবার সকাল ১১টা ৩৫ মিনিট। বেহালার বকুলতলা বাজারে গিয়ে দেখা গেল পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছেন বিক্রেতারা। উধাও নিয়ন্ত্রণবিধি। মুখের বদলে, অনেকেরই থুতনিতে ঝুলছে মাস্ক!
ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছুঁইছুঁই। বকুলতলার মতো বেহালায় পুরসভার বাজারেও একই ছবি। ব্যবসায়ী থেকে ক্রেতা— যেন নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতায় মেতেছেন। মাছ, আলু-পটল কেনায় ব্যস্ত মানুষ। বেলা গড়িয়ে প্রায় সাড়ে ১২টা। টালিগঞ্জ ফাঁড়ির ব্রিজের পাশে তখনও বাজার করতে ব্যস্ত অনেকে। ফল-সবজি থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকানে ভিড়। এ দিন প্রায় সব দোকানই খোলা। এমন কি, ওযুধের দোকানেও দূরত্ববিধি কেউ মানছেন না। বিকেল ৪টে। যেন জনজোয়ার চাঁদনিতে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে গায়ে গা লাগবেই। দোকানে পা রাখার জায়গা নেই।
বৃহস্পতিবার কলকাতায় ঠিক এর উল্টো ছবিই ধরা পড়েছিল। রাস্তা সুনসান। বাজার-দোকান বন্ধ। নাকা তল্লাশি চলছে। রাস্তায় টহল দিচ্ছেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। মুখে মাস্ক ছাড়া অথবা অপ্রয়োজনে গাড়ি-বাইক নিয়ে বেরলেই ধরপাকড়। অনেকে গ্রেফতারও হয়েছেন। সপ্তাহে দু’দিন করে রাজ্য ফের সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল লকডাউনের প্রথম দিন।
বেহালা বাজারে উধাও সামাজিক দূরত্বের বিধি। -নিজস্ব চিত্র
সকাল ৬ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল পুলিশের কড়াকড়ি। আগামিকাল শনিবার আবারও লকডাউন। মাঝের এই একটি দিন যে ভাবে আবার মানুষ রাস্তায় নামল, তাতে সংক্রমণ আটকানোর যে চেষ্টা শুরু হয়েছে তা ধাক্কা খাবে বলেই মনে করছেন চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁদের মত, প্রথমে মানুষকে সচেতন হতেই হবে। প্রশাসন জোর করে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু এর পরেও অনেকেই সচেতন হচ্ছেন না। যদি প্রশাসনকে কড়া লকডাউনের পথেই হাঁটতে হয়, তা হলে সপ্তাহের মাঝে এক দিন বা দু’দিন লকডাউনের বদলে, টানা একমাস বা তারও বেশি দিন ধরে লকডাউন করতে হবে। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন? চিকিৎসকরা বলছেন, সবাইকে দূরত্বিধি মানতে হবে। নিয়মিত হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে অথবা স্যানিটাইজ করতে হবে।
আরও পড়ুন: কোভিড আক্রান্ত ও তাঁর প্রতিবেশীর দরজা টিন দিয়ে সিল করে তোপের মুখে বেঙ্গালুরু নগরপালিকা
এ দিন শহরের বিভিন্ন প্রান্তেই ভিড়ের ছবি ধরা পড়েছে। রাস্তায় বাস-অটো-ট্যাক্সিও ভাল সংখ্যায় নেমেছে। এ দিন খোলা অফিস-কাছারি। বেহালায় ভিড়ের মধ্যে বাজার করছিলেন স্থানীয় এক বাসিন্দা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বললেন, “আগামীকাল ফের লকডাউন, তাই বাজার করে রাখছি। রবিবার আর বেরব না।” টালিগঞ্জের এক ফল বিক্রেতার মুখে মাস্ক নেই। কেন জানতে চাইলে, তাঁর যুক্তি— এই তো পরেছিলাম। সবে খুললাম। নিউ আলিপুরেরও একই রকমের অসচেতনতার ছবি ধরা পড়েছে এ দিন। ঠেলায় করে সব্জি বিক্রি করছিলেন এক যুবক। মুখে মাস্ক নেই। অনবরত কথা বলে চলেছেন ওই বিক্রেতা। কোনও রকম দূরত্ববিধি না মেনেই রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে চলছে কেনাকাটা। উত্তরের দমদম, শ্যামবাজার, সিঁথিতেও একই রকম ছবি ছিল এ দিন।
বৄহস্পতিবার সম্পূর্ণ লকডাউনে এমনই ছবি ছিল শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। -নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: করোনায় মৃত্যু হল কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিকের
কী বলছেন চিকিৎসকেরা?
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের সম্পাদক কৌশিক চাকী বললেন, “এত কিছুর পরেও সরকারের একার পক্ষে লড়াই করা সম্ভব না। মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে।” মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ) শঙ্করনাথ ঝা বলেন, “যে ভাবে এইচআইভি নিয়ে দেশে সচেতনতা গড়ে উঠেছিল, ঠিক সে ভাবেই সাধারণ মানুষের মতো ‘হেলথ এডুকেশন’ নিয়ে সচেতন গড়ে তুলতে হবে। সরকার কিন্তু বলছে না, লকডাউনের পরের দিন দূরত্ববিধি মানতে হবে না। আমাদের তো নিয়ম মানতেই হবে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিউট অব সায়েন্স একটি সমীক্ষা করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সপ্তাহে দু’দিন করে লকডাউন করলে সংক্রমণ কমবে।”
তাঁর যুক্তি, “সম্পূর্ণ লকডাউন করতে পারলে তো ভালই হত। আমরা হয়তো তা করতে পারব না। তাই দু’দিন লকডাউনের পথে হাঁটছে সরকার। দু’দিন সম্পূর্ণ লকডাউন হলে, কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ হবে। তবে এই লড়াই জিততে হলে মানুষকেই সচেতন হতে হবে।”