বেহুঁশ: নববর্ষে গয়নার দোকানে ক্রেতার ভিড়ে উধাও দূরত্ব-বিধি। এমনকি, মাস্ক পরতেও দেখা গেল না ক্রেতা এবং দোকানের কর্মীদের অনেককেই। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
দৃশ্য ১: পয়লা বৈশাখের সকালে বৈঠকখানা বাজার। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ। একটি কাগজের দোকানের এসি ঘরে হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকে গলদঘর্ম এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘এক দিন আগে পর্যন্ত জ্বর ছিল। গলায় এখনও একটু ব্যথা। ঠান্ডা কিছু খাব না। বরং মিষ্টিটা দাও।’’ দোকানমালিক লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘আপনার তো মাস্কও নেই। করোনার জন্য আমরা বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রাখিনি। প্যাকেট করেছি।’’ হালখাতা বাকি রেখেই উঠে গেলেন মাস্কহীন ভদ্রলোক।
দৃশ্য ২: কয়েক পা দূরেই আর একটি দোকানে ঢালাও খাওয়াদাওয়া চলছে কোভিড-বিধির তোয়াক্কা না করে। লুচি-আলুর দম, মিষ্টির পরে আইসক্রিম শেষ করে দোকানমালিকের উদ্দেশে এক ব্যক্তির মন্তব্য, ‘‘গত বছর তো হালখাতা করতে পারেননি। এ বারও এইটুকুতেই সারলেন!’’
শহরের সর্বত্র অবশ্য এই ‘অল্পে সারা’র চিহ্ন চোখে পড়েনি বৃহস্পতিবার। হালখাতার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে বেরোনো বহু মানুষের মুখে মাস্ক যেমন ছিল না, তেমনই উধাও হয়ে গিয়েছিল দূরত্ব-বিধিও। খেতে ব্যস্ত খদ্দেরদের দেখে বোঝার উপায় ছিল না, দৈনিক সংক্রমণের নিরিখে কার্যত গত বছরের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে করোনা পরিসংখ্যান। দিনের শুরুতে কালীঘাট-সহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে যেমন ভিড় উপচে পড়েছে, বিকেলে তেমনই ভিড় বেড়েছে পয়লা বৈখাখের জনসংযোগের নামে হওয়া মিছিল-সমাবেশে। সন্ধ্যায় সেই সব ভিড়কেই যেন টেক্কা দিয়েছে ব্যবসায়ী মহল্লার হালখাতা। যা দেখে চিকিৎসকদের বড় অংশই বলছেন, হালখাতার নামে সারা দিন যা চলল, তাতে মাস্কহীন জনতা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই আক্রান্ত হল কি না অথবা অন্যকে সংক্রমিত করল কি না, সেই হিসেব কে রাখছে?
বৌবাজারের সোনাপট্টিতে গত বছর দোকানের শাটার নামিয়ে নমো নমো করে পুজো সেরেছিলেন বছর ৬৪-র নীলকান্ত বর্মণ। রাখা যায়নি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। সেই না-পারা পুষিয়ে নিতেই যেন এ দিন তাঁর দোকানের বাইরে পাতা হয়েছিল প্রায় ৪০টি চেয়ার। বিকেলের দিকে তাতে গাদাগাদি করে বসে ছিলেন অনেকে। স্যানিটাইজ়েশন যন্ত্র কার্যত পড়ে রয়েছে অব্যবহৃত অবস্থায়। দোকানের ভিতরে ভিড়ের চিত্র তো আরও মারাত্মক। নীলকান্ত অবশ্য বললেন, ‘‘ভিড় হলেই করোনা ছড়ায় না। যা কিছু খাবার করেছি, সব পুষ্টিকর। ভয়ের কিছু নেই।’’ ‘বৌবাজার স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটি’র কার্যকরী সভাপতি বাবলু দে বললেন, ‘‘এক দিনের উৎসবে তেমন কিছু হয় না। আর কে মাস্ক পরলেন, কে পরলেন না— সেটা দেখা উদ্যোক্তাদের কাজ নয়। কড়া ভাষায় অতিথিদের মাস্ক পরতে বলাও যায় না।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমহার্স্ট স্ট্রিটের মিছিল সেরে একটা দল হাজির হয়েছিল লোহাপট্টির হালখাতা সারতে। সুবিমল চৌরাসিয়া নামে এক দোকান-মালিক সেই ভিড়ের
উদ্দেশে বললেন, ‘‘আগে তো আমার এখানে আসতে পারতেন। মিছিলে কে কার সংস্পর্শে এসেছেন, কে জানে।’’ যা শুনে দলের এক জনের মন্তব্য, ‘‘দিদির কথায় লোকে পুষ্টি পায়। ফলে করোনার ভয় করে লাভ নেই।’’
এই অযৌক্তিক কথাবার্তারই আরও বেপরোয়া চেহারা দেখা গেল বড়বাজারের ক্যালেন্ডার পট্টিতে। নতুন বছরের ক্যালেন্ডার নিতে সেখানে লোকজন একে অন্যের ঘাড়ে উঠে পড়েছেন। তার মধ্যে এক জন পানের পিক ফেলায় বাকিরা বলে উঠলেন, ‘‘যেখানে-সেখানে থুতু ফেলা বন্ধ না হলে করোনা যাবে না।’’ যাঁর উদ্দেশে বলা, তিনি পাল্টা বললেন, ‘‘যাঁরা পান খান, করোনার দোহাই দিয়ে তাঁদের লাভ নেই। শুনেছি, পানের পাতায় করোনা মরে।’’
একই রকম ভিড় শহরের শপিং মল ও রেস্তরাঁগুলিতে। সেখানে খেতে যাওয়া এক জন বললেন, ‘‘মাস্ক তো গেট পাস। রেস্তরাঁয় ঢোকার মুখে শুধু পরার জন্য।’’ হসপিটাল রোডে একটি রেস্তরাঁর সামনে হুলস্থুল বেধে যায় ভিড়ের ফাঁক গলে কয়েক জন ঢুকতে চাওয়ায়। সেখানে মাস্ক পরে থাকা এক যুবকের দাবি, ‘‘যাঁর মাস্ক নেই, তাঁর আজ খাওয়ার অধিকারও নেই। যাঁর মাস্ক আছে, সে আগে ঢুকেছে।’’
সব দেখেশুনে চিকিৎসক অরিজিৎ রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘এ তো দ্বিতীয় ঢেউ নয়, করোনা সুনামি। যা পরিস্থিতি, তাতে মাস্ক পরেও কেউ নিরাপদ নন।’’ চিকিৎসক বিমানকান্তি রায় বলেন, ‘‘এমন কোনও হাসপাতাল দেখছি না, যেখানে করোনা রোগীর শয্যা ফাঁকা আছে। তার মধ্যে এই হুল্লোড় যে কী পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে, ভাবতেই ভয় করছে। যাঁদের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা লড়াই চালাচ্ছেন, তাঁরা যদি সব জেনেবুঝেও এ ভাবে মাতামাতি করেন, তা হলে আসল লড়াইটাই ব্যর্থ হয়ে যায়।’’
আর এক চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্তের কথায়, ‘‘যাঁরা উৎসবে মাতলেন এবং যাঁরা উৎসব পালনের নামে জনসংযোগের অজুহাত দিলেন, দু’দলের কাছেই প্রশ্ন— করোনাভাইরাস এই উৎসব মানবে তো?’’
বিকেলে শহরের এক বিনোদন পার্কে আড্ডা চলছিল চার বন্ধুর। তাঁদের এক জন বলে উঠলেন, ‘‘ছাত্রদের সে দিন ভোটের সুফল পড়াচ্ছিলাম। আগামী দিনে পড়াব, ভোটের সুফল লকডাউন না হওয়া, আর লকডাউন না হওয়ার সুফল নবর্বষের উৎসব হওয়া!’’