অপেক্ষা: বিমানবন্দরের বাইরে বসে অলকা কুমারী। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
পরনে আধভেজা, ময়লা ডেনিম। এই গরমেও গায়ে সাদা ফুলহাতা সোয়েটার। পায়ে মোজা, স্নিকার্স। কোলে ছোট একটা সবুজ ব্যাগ। পাশে বড় আর একটি ব্যাগ।
মেরেকেটে বছর ২৫ বয়স। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় তাঁকে পাওয়া গেল কলকাতা বিমানবন্দরের ‘অ্যারাইভাল’-এর বাইরে, একতলায়। গুটিসুটি মেরে চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছিলেন। চার দিক নিস্তব্ধ। বিমানবন্দর থেকে যাত্রী-বিমানের ওঠানামা বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায় ৩৩ ঘণ্টা আগে। হাতে গোনা কয়েক জন নিরাপত্তাকর্মী ও অফিসার ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তাঁরাই জানালেন, গত তিন দিন ধরে ওই চত্বরেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই তরুণী। পুলিশকে বারবার বলেও লাভ হয়নি।
কী করছেন এখানে? এ দিন সকালে তাঁকে ডেকে এ প্রশ্ন করতেই ভয়ানক চটে গেলেন ওই তরুণী। চাঁচাছোলা ইংরেজিতে বললেন, “আমাকে একা থাকতে দিন।” কিন্তু এখানে কী করছেন? আপনার বাড়ি কোথায়? এ বার জবাব এল, “পরে বলব। বিরক্ত করবেন না।”
গত তিন দিন ধরে এই তরুণী ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিমানবন্দর চত্বরে। ঝরঝরে ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি ও বাংলাও বলতে পারেন। কিন্তু কেন তিনি ওখানে ঘুরছেন, তা নিয়ে সকলেই বিভ্রান্ত। নিরাপত্তাকর্মীদের সন্দেহ, মানসিক সমস্যা রয়েছে। অসংলগ্ন কথা বলছিলেন।
বেশ কয়েক বার প্রশ্ন করায় তরুণী জানান, তাঁর নাম অলকা কুমারী। বাড়ি দিল্লির কাছে গ্রেটার নয়ডায়। তাঁর অভিযোগ, “এই একই প্রশ্নের উত্তর গত তিন দিনে অন্তত একশো বার দিয়েছি। আমি ক্লান্ত, বিরক্তও। সংবাদমাধ্যম, পুলিশ, নিরাপত্তা সংস্থা— সবাইকে ঘৃণা করি। আমি তো কোনও অন্যায় করিনি। তা হলে বারবার বিরক্ত করা হচ্ছে কেন?”
অলকার দাবি, তিনি একটি প্রোজেক্টের কাজে গত রবিবার শহরে আসেন। এখানে তাঁর এক বন্ধু রয়েছেন। কিন্তু সেই বন্ধুর নাম-ঠিকানা জানাতে রাজি হননি। অলকার বক্তব্য, গত মঙ্গলবার তিনি কলকাতা থেকে দিল্লি ফেরার চেষ্টা করলেও কোনও উড়ানে জায়গা পাননি। যদিও নিরাপত্তা অফিসারেরা এ কথা বিশ্বাস করতে নারাজ। অলকার দাবি, মঙ্গলবারের পর থেকে তিনি বসে রয়েছেন বিমানবন্দরে। উড়ান ফের চালু হলে ফিরবেন বাড়ি। সেখানে তাঁর মা ও ভাই রয়েছেন।
অলকা জানান, তাঁর সঙ্গে টাকাপয়সা বিশেষ নেই। পুলিশের অনুমান, গত দু’দিন ধরে তিনি অভুক্তও থাকতে পারেন। সঙ্গের জলের বোতলও খালি। অলকার কথায়, “কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই।” আপনি কী চান? তরুণীর জবাব, “আমার ফোনটা ভেঙে গিয়েছে। তবু আমি চেষ্টা করলে চার্জ দিতে পারব। আমার কাছে নগদ টাকা নেই। হাজার পাঁচেক দরকার। কেউ যদি তাঁর অ্যাকাউন্ট নম্বর দেন, তা হলে আমি নেট ব্যাঙ্কিং মারফত টাকাটা ফেরত পাঠাব।”
টাকা নিয়ে কী করবেন? অলকা বললেন, “থাকার জন্য ডরমেটরির খোঁজ করব। মোবাইলটা সারাব। তার পরে দিল্লি ফিরে যাব।” আপনি কি জানেন, শহর জুড়ে সব বন্ধ? সম্ভবত আপনি কোনও ডরমেটরিতে জায়গাও পাবেন না। কবে উড়ান চালু হবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। তরুণী জানান, তিনি চেষ্টা করবেন। না পেলে পুলিশের সাহায্য চাইবেন।
বুধবার পণ্যবাহী দু’টি বিমান কলকাতা থেকে ওঠানামা করেছে। তার একটি গিয়েছে দিল্লি। অলকা জানান, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে সেই বিমানে তিনি দিল্লি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
নিরাপত্তা অফিসারদের প্রশ্ন, অলকার শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যে নেই, তা কে বলতে পারে? বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানান, অলকা যে হেতু গেটের বাইরে রয়েছেন, তাই তাঁর দেখভালের দায়িত্ব পুলিশের। সিআইএসএফ সূত্রের খবর, বুধবার বিষয়টি স্থানীয় থানাকে জানানো সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা হয়নি। শেষে বৃহস্পতিবার দুপুরে বিমানবন্দরের ডাক্তারদের দিয়ে অলকার পরীক্ষা করানো হয়। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজারহাটের কোয়রান্টিন সেন্টারে।