ফাইল চিত্র।
বিশ্ব জুড়ে চলছে কোভিড ১৯-এর ত্রাস। তাই বোধহয় সংক্রমণ সংক্রান্ত বড় খবরের দাপটে সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় বেরোলেও সেই খবরের গুরুত্ব কমেনি। ছোট সেই খবরটি আমার নজর এড়ায়নি। চমকে উঠেছিলাম হেডিং পড়ে― ‘বন্ধ স্কুলেও সেফ হোম’! দিনভর মাথায় ঘুরতে লাগল প্রশ্নটা। সাধারণ পাঠক হিসেবে যে খবর আমাকে ভীত করছে এর পরিণতির কথা ভেবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে কেন বিচলিত হয় না সরকার?
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, ঠিকই তো আছে। বন্ধ স্কুলবাড়িতে সেফ হোম খুলে করোনা মোকাবিলায় পদক্ষেপ করছে রাজ্য সরকার। করোনায় স্কুলগুলি ফাঁকাই পড়ে আছে, সেফ হোম তৈরির জন্য তো আর স্কুল বন্ধ করে পঠনপাঠনের ক্ষতি হচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, সরকারের এমন প্রয়াসকে অনেকে স্বাগতও জানিয়েছেন।
বহুদিন ধরেই একটা প্রশ্ন ওঠে মনে। এই দেশ বা রাজ্যে যা হয়, তার কোপ কেন পড়ে সরকারি বা সরকারের সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে? পঞ্চায়েত, বিধানসভা বা লোকসভা
নির্বাচনের বুথ কোথায় হবে? সহজ উত্তর, স্কুলে। কেন্দ্রীয় বাহিনী, যেমন সিআরপিএফ-এর থাকার জায়গা কোথায় হবে? উত্তর সেই একই, স্কুলগুলিতে। করোনা রোগীদের সেফ হোম কোথায় হবে? এরও উত্তর, স্কুলগুলিতে।
অনেকেই বলবেন, বিদেশেও সরকারি স্কুলকে নির্বাচনের বুথ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যদিও এই তুলনা টানা বাতুলতা। এটা ভুললে চলবে না, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার নিরিখে পাশ্চাত্য তো বটেই, প্রাচ্যের বহু দেশ আমাদের থেকে কয়েক ক্রোশ এগিয়ে। স্কুলে ভোটপর্বের পরে বিদেশে যে ভাবে তা পঠনপাঠনের যোগ্য করে তোলা হয়, তা এ দেশের প্রশাসনের পক্ষে অসম্ভব। ফলে ভুগতে হয় বিশেষত সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলকে। নিজে এই ধরনের স্কুলে পড়েছি। তাই জানি, বুথ বা কেন্দ্রীয় বাহিনীর আস্তানা খালি করা স্কুলের শৌচাগারে যেতে পড়ুয়া আমি, সবটুকু শক্তি দিয়ে নাক টিপে ধরতাম। এখনও পরিস্থিতি বদলায়নি বলেই জেনেছি।
তার উপরে এখন স্কুলে চালু আছে মিড-ডে মিল। বন্ধ স্কুলেও প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিনে মিড-ডে মিলের চাল-ডাল নিতে যান অভিভাবকেরা। করোনা রোগীদের জন্য সেখানে সেফ হোম খুললে মিড-ডে মিল দেওয়া কতটা নিরাপদ হবে? এই মিড-ডে মিল নিয়েই তো অভিভাবকেরা ফিরবেন সন্তানের কাছে। কোনও ভাবে তিনি সংক্রমিত হলে রেহাই পাবে না শিশুও।
কোভিডের নতুন স্ট্রেনের তথ্যের দিকে নজর রাখলেই দেখা যাবে, দ্রুত হারে সংক্রমণ ছড়ানোর সঙ্গেই কী ভাবে বাড়ছে শিশু সংক্রমিতের সংখ্যা।
অথচ, স্কুলে সেফ হোম তৈরির সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে ভাবল না সরকার? সংক্রমণ খানিক প্রশমিত হলেই স্কুল খুলবে। তখন গোটা স্কুলবাড়ি রং করে শ্রেণিকক্ষ আর শৌচাগার
জীবাণুনাশ করার সদিচ্ছা প্রশাসনের থাকবে? না কি কোষাগার ফাঁকা বলে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে এমন গুরুদায়িত্বকেও নস্যাৎ করে দেবে? অথচ শিক্ষাঙ্গনে হাত না দিয়েও সেফ হোম তৈরি করতে পারত সরকার।
কী ভাবে? বিভিন্ন জেলার সার্কিট হাউসে প্রচুর জায়গা পড়ে থাকে। সেখানেই তৈরি হোক সেফ হোম। অথবা কলকাতা হাইকোর্টের শতবার্ষিকী ভবনে। যেখানে অসংখ্য ঘর অব্যবহৃত পড়ে থাকে দীর্ঘকাল। সংক্রমণ প্রতিরোধে সব রাজ্যের হাইকোর্ট বিভিন্ন ভূমিকা নিচ্ছে। আমরাও কি তেমন নজির গড়তে পারি না? শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সেফ হোম তৈরি করা যেতে পারে বিধানসভা ও রাজভবনে। সেখানেও প্রচুর জায়গা পড়ে থাকে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। সেই স্বার্থেই না হয় যা কোনও দিনও হয়নি, নজিরবিহীন ভাবে তা-ই হোক।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)