Coronavirus in Kolkata

করোনা-থাবায় অনিশ্চয়তায় যৌনকর্মীরা

সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘরছাড়া দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা শ্রমিকদের মতোই করুণ অবস্থা মহানগরের বহু যৌনকর্মীর।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২০ ০৩:০৩
Share:

সোনাগাছির যৌনকর্মীর সন্তানদের আঁকা ছবি। নিজস্ব চিত্র

হাড়কাটা গলির পাঁচটা মেয়ের কপাল ভাল। মাঝরাতে বনগাঁমুখী আনাজের গাড়িটায় উঠে বসতে পেরেছিল। রামবাগানের মেয়ে দু’টি পারেনি। মেদিনীপুরের দেশের বাড়িতে বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে এখন চোখ ফেটে জল আসছে ওঁদের।

Advertisement

পঞ্চম সপ্তাহে পড়তে চলা লকডাউন তখন সবে শুরুর মুখে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘরছাড়া দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা শ্রমিকদের মতোই করুণ অবস্থা মহানগরের বহু যৌনকর্মীর। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, দেশগাঁয়ে তো সবাই জানেন তাঁরা কলকাতায় নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করেন। এখন যদি জানাজানি হয় যে তাঁরা আদিমতম এই পেশার সঙ্গে জড়িত, তবে হয়তো আর সেখানেও জায়গা জুটবে না। তবে এই চাপও অবশ্য নস্যি তাঁদের কাছে। কারণ আগামী দিনে এই পেশার ভবিষ্যৎ ইতিমধ্যেই প্রশ্নচিহ্নের সামনে।

লকডাউন শুরুর আগে ব্যবসা চালানোর সময়েই সোনাগাছি-কালীঘাট-খিদিরপুরে অনেক ঘরেই খদ্দেরকে প্রথমে সাবান-স্যানিটাইজ়ারে হাত ধুতে বলছিলেন যৌনকর্মীরা। এখন শঙ্কা লকডাউন উঠলেও কাজটা আগের মতো করা যাবে তো! এক জনের রোগ ধরলে তো হু-হু করে ছড়িয়ে পড়বে। পরিবার-প্রিয়জনেদেরও বাঁচানো যাবে না।

Advertisement

বাঁচার পথ খোঁজার আকুতিতে যৌনকর্মীরা অনেকেই তলিয়ে যাচ্ছেন অবসাদের গহনে।

আরও পড়ুন: এতটা রাস্তা ছেলেকে নিয়ে কী ভাবে যাব, এখন সেটাই ভেবে চলেছি

কালীঘাটের যৌনপল্লির কাছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে সম্প্রতি ভিডিয়ো কনফারেন্সে মনোবল বাড়ানোর প্রশিক্ষক বা জনৈক মোটিভেশনাল ট্রেনারের মুখোমুখি বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল বর্ধমানের মেমারির চাঁপা, বারাসতের সাবিনা কিংবা সুদূর নেপালের সীমা তামাংকে (নাম পরিবর্তিত)। স্বামীহীনা চাঁপার সাত ও দশ বছরের দু’টি বাচ্চা মা-বাবার কাছে। পয়লা বৈশাখ ফেরার কথা ছিল। “আমি অনলাইনে টাকা পাঠাতে পারি না। পাড়ার সোনার দোকানে প্রতি হাজারে ২৫ টাকা সুদে চেয়েচিন্তে সংসার চলছে। ফোনে কথা বললেই বাচ্চারা মা পয়সা দাও-দাও বলে অস্থির করে দেয়।”— ফোনে বলছিলেন তরুণী। কালীঘাটে সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার ঊর্মি বসুর কথায়, “চালডালের চাহিদা ছাড়াও মানসিক অবসাদ একটা বড় সমস্যা হতে চলেছে যৌনকর্মীদের জন্য।” রাজ্য জুড়ে সক্রিয় যৌনকর্মীদের বড় অংশের নিজস্ব একটি সংগঠনের উপদেষ্টা স্মরজিৎ জানা বলছেন, “মে মাসে তালাবন্দি উঠলেও ছোঁয়াচে রোগ ঠেকাতে আরও অন্তত এক মাস যৌনকর্মীদের খদ্দের না-নেওয়াই ভাল। সোনাগাছিতেই অন্তত ২০০০ যৌনকর্মী সাহায্য ছাড়া বাঁচবে না। মুখ্যমন্ত্রীকেও এ বিষয়ে চিঠি লেখা হয়েছে।”

আরও পড়ুন: তালাবন্দি শহরে এলাকার অভুক্তদের পাশে ওঁরা

সরকারি-বেসরকারি সাহায্য অবশ্য কলকাতায় আসছে বিক্ষিপ্ত ভাবে। এর মধ্যে সোনাগাছিতে শাসক দলের তরফে অপর্যাপ্ত ত্রাণ বিলির অভিযোগে গোলযোগ বেঁধেছে। তবে এডস ঠেকাতে কন্ডোম ব্যবহারে সচেতনতা থেকে জনস্বাস্থ্যের নানা কাজে শরিক হওয়ায় অভিজ্ঞ যৌনকর্মীরা কোভিড প্রতিরোধেও সরকারের শরিক হতে চান। অনেকের ধারণা, তাতে রুটিরুজিরও খানিক হিল্লে হবে।

শহরের লালবাতি এলাকার খুপরি ঘরগুলোয় সব থেকে অসহায় দশা ডানপিটে জবালাসুতদের। সন্তানদের আটকাতে মায়েরা মোবাইল হাতে তুলে দিচ্ছেন, যদি কার্টুন দেখে তারা ভুলে থাকে। কালীঘাটে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে খুদেদের জন্য লুডো, আঁকার খাতা জোগাড় করা হয়েছে। চালডালের বাইরে বাচ্চাদের মুখরোচক তেলমুড়িমাখা কিংবা বিস্কুটের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। সোনাগাছিতেও হাতে-হাতে রং পেনসিল। দমবন্ধ আবহে লুডোর ঘুঁটির মতোই ঘরবন্দি খুদেদের আঁকার খাতাটুকুই তখন কথা বলে ওঠে।

মরিয়া হয়ে সাদা খাতা রঙে ভরছে নাছোড় শৈশব। খাতাতেই ডানা মেলছে মুক্তির আকাশ।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement