সংক্রমণ রুখতে দক্ষিণ কলকাতার একটি বহুতলের লিফট জীবাণুমপক্ত করার কাজ চলছে। নিজস্ব চিত্র।
শহরের বহুতল আবাসনগুলি ভয় ধরিয়েছিল গত বছর করোনার বাড়বাড়ন্তের সময়ে। এমনই এক আবাসনের বাসিন্দা, এক আমলা-পুত্রের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় প্রথম শোরগোল পড়ে। সেই ভয়ই যেন নতুন করে ফিরতে শুরু করেছে আবাসনগুলিতে। সর্বত্রই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে কোথাও গাড়ির চালক বা সাফাইকর্মীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কোথাও বন্ধ করা হয়েছে আবাসন চত্বরে নেমে ছোটদের খেলা। বাইরে থেকে ভিড় করে ভোটের প্রচারে আসেন যাঁরা, নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাঁদের প্রবেশও।
এমন নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে গত সপ্তাহে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী লোকনাথ চট্টোপাধ্যায়। দিনভর ঘুরে তিনি বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি বহুতল আবাসনে ঢোকার চেষ্টা করেন। সেখানকার নিরাপত্তারক্ষীরা নিষেধ করলেও প্রার্থী তাতে আমল দেননি বলে অভিযোগ। “কিছু হলে আমি বুঝব” বলে কার্যত জোর করেই ঢুকে যান লোকনাথবাবু। ১৪তলা একটি টাওয়ারের পাঁচতলায় উঠতেই রাগে চেঁচাতে শুরু করেন এক ব্যক্তি। নিরাপত্তারক্ষীকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, “আবাসন কমিটির নির্দেশ অমান্য করে এঁকে কে ঢুকতে দিয়েছেন? করোনা বাড়লে তার দায়িত্ব কে নেবেন?” রক্ষীর দোষ নেই, তিনি নিজেই ঢুকেছেন বলে লোকনাথবাবু জানালে এর পরে ওই ব্যক্তি বলতে শুরু করেন, “আমার স্ত্রীর করোনা হয়েছে। বাইরের কাউকেই আমরা চাইছি না। আপনি এ ভাবে ঢুকে পড়ে ঠিক করেননি।” হাওয়া খারাপ বুঝে দ্রুত চলে যেতে বাধ্য হন ওই প্রার্থী। লোকনাথবাবুর অবশ্য প্রতিক্রিয়া, “তেমন কিছু হয়নি। ওঁরা ভয় পেয়েছেন, বেরিয়ে এসেছি।”
বালিগঞ্জেরই আর একটি বহুতল আবাসনের সম্পাদক নীহার ঘোষ যদিও বললেন, “ভোটের জন্যই করোনার এই হাল। আমরা একটা কমিউনিটির মধ্যে থাকি। সেখানকার স্বাস্থ্য কোনও ভাবেই খারাপ হতে দেওয়া চলে না। প্রার্থীরা এই বাস্তবটা না বুঝলে অপমানিত হয়েই ফিরতে হবে।” উল্টোডাঙা মেন রোডের এক বহুতল আবাসনের সভাপতি সুশীল সিংহ আবার বিরক্ত হয়ে বললেন, “করোনা রোখার সব রকম ব্যবস্থা করেছি। বাইরের সকলেই নিষিদ্ধ। ভোট চাইতে আসার ভিড় তো সবার আগে নিষিদ্ধ করেছি। কারণ, ওই ভিড় পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে করোনা
নিয়ে আসে।”
মুকুন্দপুরের একটি বহুতল আবাসনের সভানেত্রী সোমা ঘোষের বক্তব্য, “প্রথম থেকেই ভোটের জন্য আসা ভিড় নিষিদ্ধ করেছিলাম। এখন তো করোনার রূপ ভয়ানক। বহু প্রতিবেশীই আক্রান্ত। নিজেদের উদ্যোগে রোজ স্যানিটাইজ়েশন করানোর পাশাপাশি ছোটরাও যে হেতু আক্রান্ত হচ্ছে, তাই আবাসন চত্বরে ওদের খেলা বন্ধের নির্দেশ দিতে হয়েছে। বাইরে থেকে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আবাসন চত্বরেই আমরা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে বাজার বসানোর ব্যবস্থা করেছি। একটি স্বাস্থ্য শিবিরও খোলা হয়েছে। তাতে জরুরি প্রয়োজনের কথা ভেবে অক্সিজেন সিলিন্ডারও থাকছে।” পঞ্চসায়রের কাছে যে আবাসনে গত বছর আমলা-পুত্রের সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা শোরগোল ফেলেছিল, সেখানকার সম্পাদক নীলাঞ্জন দাস বললেন, “নেতা-নেত্রী তো বটেই, বাইরের সকলের প্রবেশের উপরেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলাম আমরা। তা সত্ত্বেও আক্রান্ত হওয়া আটকানো যায়নি। আরও আবাসিকের আক্রান্ত হওয়া আটকাতে কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা একটা প্রতিষেধক শিবির করতে চলেছি। আবাসনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা তো বটেই, এখানকার বাসিন্দারা যাঁরা এখনও প্রতিষেধক পাননি, তাঁরাও প্রতিষেধক নিতে পারবেন সেখানে।”
যদিও এই সচেতনতার অনেকটাই উধাও ই এম বাইপাসের ধারে বেশ কয়েকটি বহুতল আবাসনে। একই পরিস্থিতি এ জে সি বসু রোড, বেলেঘাটা ও গিরিশ পার্ক এলাকার বেশ কয়েকটি বহুতল আবাসনেও। সেখানে এখনও সকলেরই অবাধ যাতায়াত। যাঁরা আসা-যাওয়া করছেন, তাঁদের তো বটেই, সেখানকার নিরাপত্তারক্ষীদেরও অনেকের মাস্ক পরার বালাই নেই। এমনই একটি আবাসনের রক্ষীর উত্তর, “গেটে সাবান-জল আছে, তাতেই হবে। কারও গাড়ি ঢুকতে বা বেরোতে দেখলেই মাস্ক পরে নিচ্ছি।” ই এম বাইপাসের একটি আবাসনের সম্পাদক পৃথ্বীশ মুখোপাধ্যায়ের যদিও মন্তব্য, “কোনও আবাসন কমিটি সরকারের ঊর্ধ্বে নয়। সরকারই যদি লকডাউন ঘোষণা না করে, আমরা লোকের প্রবেশ আটকাই কী করে? তবে করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে সব দিক থেকেই সচেতন আছি।”
মানিকতলা মেন রোডের একটি বহুতল আবাসনে আবার বুধবারই একটি রাজনৈতিক দলের সভা হয়েছে। সেখানকার ভিড় সামলে বিরক্ত এক নিরাপত্তারক্ষী বললেন,“যাঁরা সভা দেখলেন, তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা লোক এই আবাসনের বাসিন্দা। এমন বাইরের লোকই ঢুকে দেদার করোনা ছড়াচ্ছে। এখানে গত সাত দিনে ১৬টি পরিবার আক্রান্ত হয়েছে। আরও আক্রান্ত বাড়লে কাজই ছেড়ে দেব।”