ফাইল চিত্র।
বাড়ির লোক বুঝতেই পারছিলেন না, হঠাৎ করে মেয়েটি কেন এমন আচরণ করছিলেন। প্রথমে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার পরে জুতো, এমনকি, জামাকাপড়ও পরতে চাইছিলেন না। যা ২৫-২৬ বছরের এক তরুণীর পক্ষে চূড়ান্ত অস্বাভাবিক। সংশ্লিষ্ট তরুণীর মা জোর করে জামাকাপড় পরাতেন। যে স্ত্রী-রোগ চিকিৎসককে তরুণী দেখাতেন, তিনিও প্রথমে বুঝতে পারেননি এই অসংলগ্ন আচরণের কারণ। শেষ পর্যন্ত তিনিই তরুণীকে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
সেই মতো দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা ওই তরুণীকে শহরের মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তরুণীকে পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন, চার দিকে করোনায় মৃত্যুর খবর তরুণীর মনে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলেছে। যার জেরে তাঁর এবং বাস্তব জগতের মধ্যে ‘বিচ্ছিন্নতা’ তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে কথা বলা বন্ধ থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রির অধিকর্তা প্রদীপ সাহা বলছেন, ‘‘করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ যে অনিশ্চিত আবহ তৈরি করেছে চার দিকে, তার প্রভাব পড়েছে তরুণীর সংবেদনশীল মনে। সেটাই আচরণগত ডিজ়অর্ডারের মূল কারণ।’’
চিকিৎসার পরে তরুণী আপাতত সুস্থ হয়ে উঠলেও মনোবিদদের বক্তব্য, এই ঘটনা বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন মাত্র। কারণ, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ জনমানসের একাংশে একটা পরিবর্তন এনেছে। ব্যাখ্যা করে তাঁরা জানাচ্ছেন, সংক্রমণের প্রথম পর্বে আতঙ্ক ছিল, উদ্বেগ ছিল। ‘আমি বা পরিবার বা প্রিয়জনেদের কেউ সংক্রমিত হবে না তো!’— এটাই ছিল সেই আতঙ্কের মূল কারণ। জার্মোফোবিয়া (ব্যাক্টিরিয়া, ভাইরাস-সহ যে কোনও প্যাথোজেনজনিত সংক্রমণের আতঙ্কে ভোগা), ডক্টর শপিং সিনড্রোম-সহ (সব সময়েই কোনও না কোনও অসুখ রয়েছে, ধরে নিয়ে ঘন ঘন চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া) একাধিক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ সেই মানসিক গঠনে কিছুটা হলেও বদল এনেছে। ক্রমাগত পরিচিত বৃত্তের মধ্য থেকে মৃত্যুর খবরে একটা চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। একটা মৃত্যুর খবর সামলে উঠতে না উঠতেই আরও একটি মৃত্যুর খবর মানুষকে মানসিক ভাবে ধ্বস্ত করে দিচ্ছে বলে জানাচ্ছেন মনোবিদেরা। এক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের ব্যাখ্যা, এর কারণ মৃত্যুর খবরগুলো আর দূরে নেই। ক্রমশই তা পরিচিত, অতি পরিচিত থেকে নিকটাত্মীয়, পরিবারের লোকের মধ্যে থেকে আসছে। গত তিন মাসের করোনা অতিমারির ধারা বলছে, প্রায় প্রতিটি সকাল এমন কারও মৃত্যুর খবর দিয়ে শুরু হয়েছে, যাঁর বা যাঁদের সঙ্গে নিজের জীবনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। তাঁর কথায়, ‘‘চেনা মুখেরা হঠাৎ করেই ব্যক্তিগত বৃত্ত থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। যার গভীর প্রভাব পড়ছে মনে। পরদিন সকালেও আর একটা মৃত্যুর খবর পেতে পারি, এই মানসিকতা জাঁকিয়ে বসছে ভিতরে।’’ সেই শোকের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সামাজিক বা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে ‘উইথড্রয়াল’-এর মাধ্যমে।
‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ, গাঁধীনগর’-এর বিজ্ঞানী, মনোবিদ অপূর্বকুমার পাণ্ডা জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে অনেকে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। প্রিয় ও পরিচিতদের হারানোর শোকের অভিঘাত তাঁদের এমন ভাবে গ্রাস করছে, তাঁরা বুঝতে পারছেন না ঠিক কী ভাবে এই শোকের থেকে মুক্তি পাবেন। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। আতঙ্ক পাল্টে গিয়েছে বিষণ্ণতায়। আগামী দিনে ঠিক থাকব কি না, সেটাই অনেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।’’ কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মানসিক বিপর্যয়ের কাউন্সেলিংয়ের জন্য ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টস’ গঠিত বিশেষ ‘ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট টাস্ক ফোর্স’-এর সদস্য প্রশান্তকুমার রায়ের বক্তব্য, ‘‘মৃত্যু আমার ঘরেও হানা দেবে না তো?— করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের জেরে জনগোষ্ঠীর একটা অংশ এই বিপন্নতায় ভুগছেন!’’