বিপদ-সঙ্কেত: দু’দিনের বৃষ্টিতে জমা জল ফিরিয়ে এনেছে ডেঙ্গির আশঙ্কা। বুধবার, সল্টলেকের লাবণিতে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
মাত্র দশ দিনের ব্যবধান। তাতেই ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছিল প্রায় ২১ হাজার। রাজ্য সরকারের হিসেব অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ অক্টোবর এ রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ হাজার। সেটাই ৯ নভেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৮৫২। ঘটনাচক্রে এর এক মাস পরেই কোভিড-১৯ সংক্রমণের খবর জানা যায় চিনে। যার দু’মাস পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রিপোর্ট পেশ করে, চারটি দেশ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছে। সেই শুরু! তার পর থেকেই সারা বিশ্বে এক অদৃষ্টপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কিন্তু কোভিডের প্রবল উপস্থিতির পাশাপাশি ডেঙ্গিকেও আর উপেক্ষা করা যাবে না বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। বরং করোনা-পরিস্থিতিতে ডেঙ্গি সংক্রমণ সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই লন্ডভন্ড করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তাঁরা। আশঙ্কার কারণ, গত দু’দিনের বৃষ্টি। যা ছোট পাত্রে, রাস্তার গর্তে বা অন্যত্র জল জমে তৈরি করে মশার আঁতুড়ঘর। যদিও এখন গরমকাল, তাই ওই জল তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু করোনা সংক্রমণ কত দিনে কমবে, সে ব্যাপারে সকলেই অন্ধকারে। এখনও পর্যন্ত গবেষকদের যা অনুমান, তাতে আরও বেশ কয়েক মাস। সে ক্ষেত্রে ডেঙ্গি মরসুমও তত দিনে পুরোপুরি শুরু হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন পুরোপুরি ভাবে কোভিড-১৯ কেন্দ্রিক। তার উপরে এই শহরেই একাধিক হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স কোয়রান্টিনে যাওয়ায় বর্তমান স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কতটা ডেঙ্গির মোকাবিলায় তৈরি, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। বিশেষ করে যেখানে ক্যানসার-সহ অন্য একাধিক গুরুতর রোগের চিকিৎসা কার্যত থমকে রয়েছে।
‘ন্যাশনাল ভেক্টর বোর্ন ডিজ়িজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’-এর প্রাক্তন অতিরিক্ত অধিকর্তা রাজেন্দ্র শর্মা বলেন, ‘‘ডেঙ্গির মরসুম শুরু এখনই। আর করোনাভাইরাসের কারণে তা থেমে থাকবে না। ১৯৭০ সালে বিশ্বের ন’টি দেশ ডেঙ্গি আক্রান্তের তালিকায় ছিল। বর্তমানে তার সংখ্যা কমপক্ষে ১৩০। ফলে ডেঙ্গি প্রতিরোধের জন্য সাফাইয়ের কাজ, মশার আঁতুড়ঘর ধ্বংসের কাজটাও করা প্রয়োজন।’’ বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, কী ভাবে গত দু’দশকের মধ্যে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বিশ্বে। এক গবেষকের কথায়, ‘‘২০০০ সালে বিশ্বে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের ডেঙ্গি হয়েছিল। ২০১০ সালে হয় প্রায় ২৪ লক্ষের। তারও পাঁচ বছর পরে, অর্থাৎ ২০১৫ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩৩ লক্ষে!’’ ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’-এর ডেঙ্গি নিয়ে কাজ করা পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো অরুণ শঙ্করাডোস বলেন, ‘‘মরসুমে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে ঠিকই। কিন্তু এখন সারা বছরই ডেঙ্গি হয়। ডেঙ্গি চিহ্নিতকরণের পরীক্ষা সহজ হলেও সারা দেশেরই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরে এখন চাপ রয়েছে। তাই ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণের কাজে সামান্যতম ফাঁক থাকলে হবে না। করোনা-আতঙ্কে মরসুমি ডেঙ্গিকে ভুললে বিপদ!’’
আরও পড়ুন: নিস্তব্ধ গয়নাপাড়া, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে কারিগরেরা
প্রশাসন সূত্রের খবর, গত মাসেই রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর নির্দেশিকা জারি করে শহরাঞ্চলে ডেঙ্গি-সমীক্ষা শুরুর কথা জানিয়েছিল। গত ১৫ এপ্রিল ডেঙ্গি নিয়ে বিশেষ বৈঠকে ডেঙ্গি-অভিযানের একটি নির্দেশিকা জারি করেছে কলকাতা পুরসভাও। সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে মাস্ক ও গ্লাভস পরে ডেঙ্গি প্রতিরোধের কাজ করতে বলা হয়েছে। পুরসভার মুখ্য পতঙ্গবিদ দেবাশিস বিশ্বাস বলেন, ‘‘লকডাউনের কারণে অনেকেই বাড়িতে রয়েছেন। এই বাড়ি থাকাকে ডেঙ্গি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা হিসেবে দেখতে হবে। কারণ, বাড়ির মধ্যে যাতে জল না জমে তা সকলে মিলে খেয়াল রাখা সম্ভব। বাড়ির বাইরে পুর-স্বাস্থ্যকর্মীরা খেয়াল রাখছেন।’’
পুরসভা সূত্রের খবর, গত বছর কয়েকটি ওয়ার্ড-বরোকে ডেঙ্গিপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তার মধ্যে ৯ নম্বর বরোর চেয়্যারম্যান রতন মালাকার বলছেন, ‘‘মূল নজরটা করোনাভাইরাসের দিকেই রয়েছে। তার মধ্যেই যতটা সম্ভব ডেঙ্গি প্রতিরোধের কাজ করা হচ্ছে।’’ ১৩ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান সুশান্ত ঘোষের বক্তব্য, ‘‘সচেতনতামূলক প্রচারের কাজ চলছে।’’ যদিও পতঙ্গবিদ গৌতম ভদ্রের কথায়, ‘‘কোভিড ১৯-এর কারণে বাকি সব প্রচারই গৌণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গি হতে পারে, এই ভাবনা নিয়েই সচেতনতার প্রসার প্রয়োজন। আর তা দায়সারা ভাবে করলে হবে না। কারণ, এই মুহূর্তে আরও একটা রোগের চাপ শুধু স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেন, আমরাও নিতে পারব না!’’
আরও পড়ুন: জেল-কাণ্ডে মৃত কত, অজানা ১ মাস পরেও