আশায় আশায়: কেউ করোনা পরীক্ষা করাবেন। কেউ আবার সংগ্রহ করবেন পরীক্ষার রিপোর্ট। তারই লাইন এম আর বাঙুর হাসপাতালে। সোমবার। ছবি: সুমন বল্লভ।
করোনার সংক্রমণ যত বাড়ে, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ে আক্রান্তের সামাজিক অসহায়তা। সেই সঙ্গেই কখনও অ্যাম্বুল্যান্স, কখনও শয্যা, কখনও আবার কোভিড পরীক্ষার নামে বেড়ে চলে ঝোপ বুঝে কোপ মারার ব্যবসায়িক ফাঁদ। গত বছরের একটা বড় সময় জুড়ে দেখা গিয়েছিল এই চিত্র। করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ বার যা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে বলে অভিযোগ। ভুক্তভোগীদের দাবি, পরীক্ষার নামে রোগীর পরিবারের কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়েই এই মুহূর্তে চলছে রমরমা ‘করোনা ব্যবসা’! পুলিশ-প্রশাসন তো বটেই, স্বাস্থ্য দফতরেরও এ নিয়ে হুঁশ নেই বলে অভিযোগ চিকিৎসকদের বড় অংশের।
যাদবপুরের শ্রী কলোনির বাসিন্দা, পেশায় শিক্ষক সুধাংশু দত্তগুপ্ত যেমন সমাজমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, একটি করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে তাঁর পাঁচ হাজার টাকা খোয়া গিয়েছে। তিনি জানান, বাড়িতে তাঁর বয়স্ক বাবা-মা রয়েছেন। জ্বর আর সর্দি দেখে করোনা পরীক্ষা করিয়ে নেবেন ঠিক করেন তিনি। করোনার পরীক্ষা যারা করে, এমন কয়েকটি সংস্থার নাম তিনি জানতে পারেন পরিচিতদের থেকে। অনলাইনে এমন দু’টি সংস্থার ফোন নম্বর পান তিনি। তবে দু’টি সংস্থাই ফোন ধরে জানায়, তাদের কলকাতার দফতরে এই মুহূর্তে করোনার পরীক্ষা হচ্ছে না। এর পরে আর একটি সংস্থার নম্বর পান তিনি। তারা জানায়, পরীক্ষা হচ্ছে। প্রথমে নাম নথিভুক্তির জন্য দেড় হাজার টাকা অনলাইনে জমা দিতে হবে। এর পরে যে দিন পরীক্ষার জন্য লোক যাবে, সে দিন আরও দেড় হাজার টাকা দিতে হবে। টাকা দেওয়ার পরের দিন নমুনা সংগ্রহের তারিখ পান সুধাংশুবাবু। তাঁর অভিযোগ, যে সময়ে নমুনা নিতে আসার কথা, তার এক ঘণ্টা আগে ফোনে ওই সংস্থা জানায়, রোগীর চাপ খুব বেড়ে গিয়েছে। ফলে এখনই সাড়ে তিন হাজার টাকা জমা না দিলে নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। সুধাংশুবাবুর কথায়, “সন্দেহ হলেও আরও সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে দিই। মোট পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দেওয়ার পরেও আজ পর্যন্ত কেউ নমুনা নিতে আসেননি। ওই নম্বরে আর ফোনও লাগে না।”
বেহালা চৌরাস্তার বাসিন্দা স্নেহা সরকার নামে এক মহিলার আবার দাবি, একই ভাবে প্রতারিত হয়ে তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, “অনলাইনে হাজারো ভুয়ো ফোন নম্বর ঘুরছে। বয়স্ক শ্বশুর-শাশুড়ির জ্বর দেখে কোভিড পরীক্ষার জন্য অনলাইনে খোঁজ করছিলাম। একটি নম্বরে ফোন করায় বড় একটি বেসরকারি হাসপাতালের নাম করে কথা বলা হয়। এর পরে অনলাইন লেনদেনের একটি অ্যাপের কিউআর কোড পাঠিয়ে বলা হয়, দু’জনের নাম নথিভুক্ত করার জন্য দু’হাজার টাকা পাঠাতে হবে ওই কোড স্ক্যান করে। কিন্তু স্ক্যান করতেই ব্যাঙ্ক থেকে ২২ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়।” পরীক্ষা তো হয়ইনি, উল্টে কলকাতা পুলিশের সাইবার শাখায় ইমেলে অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও সুরাহা মেলেনি বলে দাবি তাঁর।
উল্টোডাঙার একটি পরিবারের আবার অভিযোগ, সরকারি ওয়েবসাইটে পাওয়া সংস্থার নাম ধরে খোঁজ করেও দু’দিন ধরে করোনার পরীক্ষা করাতে পারেনি তারা। অভিযোগ, একাধিক সংস্থা ফোন ধরে জানিয়েছে, করোনার পরীক্ষা করা হচ্ছে না। টাকা জমা দিয়ে নাম লিখিয়ে রাখলে পরে ডাকা হতে পারে। একটি ভুয়ো সংস্থা আবার ফোন ধরে বলে, “করোনা হলে পরীক্ষায় কী হবে? বাঁচলে বাঁচুন, নয় মরুন।”
চিকিৎসক কুণাল সরকার বললেন, “এ জিনিস নতুন নয়। যখনই করোনার সংক্রমণ লাগামছাড়া হয়, তখনই এমনটা ঘটে। আমি যে বেসরকারি হাসপাতালে যুক্ত, সেখান থেকেই গত বছর একাধিক এফআইআর করতে হয়েছিল এ নিয়ে। দেখা গিয়েছিল, ভুয়ো সংস্থা খুলে আমাদের হাসপাতালের নাম করেই ভুল রিপোর্ট দিয়ে দেওয়া হয়েছে।” কুণালবাবু আরও বলেন, “দু’তারিখের পরে ফের লকডাউন হতে পারে ভেবে অনেকেই আখের গোছাতে এখন করোনা ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন।” চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত আবার বললেন, “এক বছর আগেকার ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মাঝে একটা বছর সময় পেয়েও তার মানে আমরা কিছুই করতে পারিনি। টেস্ট বাড়ান, টেস্ট বাড়ান করে চেঁচানো হয়েছে, কিন্তু ভুয়ো পরীক্ষা রোখার ব্যবস্থা হচ্ছে না।”
চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার জানালেন, আইসিএমআর-এর অনুমোদনপ্রাপ্ত কিছু বেসরকারি সংস্থা করতে পারলেও সরকারি স্তর থেকে এখনও বাড়ি গিয়ে করোনা পরীক্ষা শুরু করা যায়নি। এতে যেমন ভুয়ো সংস্থার বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, তেমনই ‘সার্ভিস চার্জ’-এর নামে চলছে দেদার টাকা হাঁকা। মোটের উপরে ৯৫০ টাকায় যে আরটিপিসিআর পরীক্ষা হয়ে যায়, তারই দর উঠে যাচ্ছে চার-পাঁচ হাজারে। তাঁর কথায়, “দুই থেকে চার ডিগ্রি উষ্ণতার মধ্যে দ্রুত নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হয়। তা-ও হচ্ছে না বহু ক্ষেত্রেই। যিনি নমুনা সংগ্রহের জন্য আসছেন, তাঁর না আছে প্রশিক্ষণ, না আছে সচেতনতা।”
তা হলে উপায়? স্বাস্থ্য দফতরের কেউ মন্তব্য করতে চাননি। এক শীর্ষ আধিকারিক শুধু বলেন, “ছোট ছোট গাড়িতে এলাকায় এলাকায় পরীক্ষার ব্যবস্থা পৌঁছে দেওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে আলোচনা চলছে। যত দিন না তা হচ্ছে, সরকারি বা বেসরকারি কোনও হাসপাতালে গিয়েই পরীক্ষা করানোই ভাল।” নমুনা সংগ্রহে এসে যেমন খুশি টাকা হাঁকা প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী বললেন, “ওই ভাবে গেলে তো করোনা না হলেও করোনা নিয়ে ফিরবেন! তার চেয়ে বাড়িতে বসে আমাদের থেকেই তো করানো ভাল। এই ভালটা বুঝেই তো আমরা একটু বেশি টাকা চাইলেও লোকে রাগ করছে না। এখন পরিস্থিতি এমন যে, রাগ করলে নিজেরই বিপদ!”