— প্রতীকী ছবি।
রাত আটটা। শ্যামবাজারমুখী ৪৭বি বাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে অফিস ফেরতা ক্লান্ত কলকাতা। কখনও ঢিমে তালে কখনও বা একটু স্পিড বাড়িয়ে চলছিল বাস। শোভাবাজার ক্রসিং পেরিয়েই বাঁ দিক ঘেঁষে হঠাত্ ব্রেক কষল। একটু পিছনে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্টের স্ট্যান্ড করা মোটরবাইকের দিকে কন্ডাক্টরের এগিয়ে যাওয়া পর্যন্ত চেনা ফ্রেম।
‘বাদাম, মটরশুঁটি, ডালমুট…’ চেনা ডাকের মধ্যে কেউ জানলার ধারে আস্তে করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, ‘কেস খা না হলে পাঁচশো টাকার নোট ভাঙিয়ে দিয়ে যা, শা…।’ আরে! এ তো কন্ডাক্টর! বাসের পাদানিতে দাঁড়িয়ে ঘন্টি দিতেই ছাড়ল বাস। ততক্ষণে সেই রাগী গলাটা শুনেছেন বাসের অনেকেই। ‘এই কী হল ভাই’, ‘কী বলল মামা?’ উত্সাহী প্রশ্নের মুখের সমবেত প্রশ্নের সামনে আরও একবার (এ বার বেশ জোরেই, বাস ততক্ষণে শ্যাম পার্ক) ‘কেস খা না হলে পাঁচশো টাকার নোট ভাঙিয়ে দিয়ে যা’ বলে উঠলেন কন্ডাক্টর।
‘‘হবে আবার কী, ওর থেকে পাঁচশো টাকার নোট ভাঙিয়ে নিল জোর করে’’ বলে উঠলেন জানলার ধারে বসে থাকা মধ্যবয়সী মহিলা। তখনও ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। টিকিট চাইতে আসতেই ধরলাম কন্ডাক্টরকে। দিলীপ পাল। ১০ বছর এই রুটে কন্ডাক্টরি করছেন। কেসটা কী? ‘‘কী বলল বুঝলেন না? পুরনো পাঁচশো টাকার নোট ভাঙিয়ে দিতে হবে। না দিলেই কেস দেবে পুলিশ। কে বেকার একশো টাকা দেবে বলুন, বাধ্য হয়ে ভাঙিয়ে দিচ্ছি’’ বেশ হতাশ হয়ে বললেন দিলীপ।
নিশ্চয়ই ওভারটেক করেছিলেন। না হলে তো ট্রাফিক পুলিশ শুধু শুধু আপনার বাস দাঁড় করাবে না। এ বার হাল ধরলেন ড্রাইভার পরেশ সাঁপুই। ‘‘দেখলেন তো আগের বাসের পিছন পিছন আসছি। এমনিতেই লোক কম বলে টেনে চালাচ্ছি না। আর সত্যিই যদি ওভারটেক করতাম, ব্যাটারা ১০০ টাকা না নিয়ে ছাড়ত?’’ বেশ রেগে উঠলেন পরেশ।
গল্পের শুরু দিন কয়েক আগে। গত ৮ নভেম্বর রাতারাতি ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদী সরকার। তার পর ব্যাঙ্কে দীর্ঘ লাইন, এটিএমে ‘নো মানি’ বোর্ড, নতুন ২০০০ টাকার নোটের ‘পিঙ্ক’ রেভোলিউশন, ১০০ টাকার নোটের জন্য চাতক-চাহনি, খুচরোর আকাল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লিতে প্রতিবাদ— এ হেন বহু জল গড়াতে দেখেছেন মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ার নিত্যনতুন ‘নোট’ রসিকতাও এখন অনেকটাই গা-সওয়া। কিন্তু সেই রসিকতার যে এমন ‘আঁখো দেখি’ বাস্তব রয়েছে, তা না দেখলে জানা মুশকিল।
কিন্তু এ ভাবে কতদিন ধরে ৫০০-র নোট ভাঙিয়ে দিচ্ছেন? দিলীপ বললেন, ‘‘মোদীজি তো বলেই শেষ। আমরা যে কী করে চালাচ্ছি আমরাই জানি। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন এমন অনেক রুটের বাসেই করছে পুলিশ। আরে বুঝলেন না, ডাক্তার, উকিল আর পুলিশ— এদের কি টাকার কোনও হিসেব আছে? যত ভোগান্তি আমাদের।’’ বাসে বসা আরও এক যাত্রী বলে উঠলেন, ‘‘আমি রোজ যাচ্ছি। এভাবে টাকা ভাঙানোটা নতুন শুরু করেছে পুলিশ। এরা কী করবে বলুন? বাধ্য হয়ে দিচ্ছে। না হলে বিনা কারণে কেস খাবে।’’
পুলিশ কী বলছে? চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মী বললেন, ‘‘এখন তো হাতে হাতে জরিমানা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। অনলাইন চালান কাটার ব্যবস্থা আছে।’’ কিন্তু এ তো জরিমানা নয়, জোর করে খুচরো আদায়! কসবা ট্রাফির গার্ডে কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মীর কথায়, ‘‘ব্যক্তিগত ৫০০ টাকার নোট নিয়ে অসুবিধেয় পড়েছি এটা ঠিক। কিন্তু এমন কখনও করি না।’’ জোড়াবাগান ট্রাফিক গার্ডের ওসি অলোক সান্যাল (যাঁর এলাকার মধ্যেই পড়ে শোভাবাজার ক্রসিং) বললেন, ‘‘বাজে কথা এ সব। আর শনিবার রাত থেকেই তো খুচরোর সমস্যার জন্য স্পট ফাইন বাতিল হয়ে গিয়েছে।’’
হতে পারে পুলিশ এ ভাবে টাকা ভাঙানোর কথা স্বীকার করছে না। হাত পেতে ঘুষ নেওয়ার কথা অন রেকর্ড কে-ই বা কবে বলেছে! কিন্তু শনিবাসরীয় সন্ধে রাত, শোভাবাজার ক্রসিং, ডব্লিউ বি ০৪ এফ ৯৬৫৭ নম্বরের বাসের কেস খাওয়া না খাওয়ার লুকোচুরি, আর কন্ডাক্টর দিলীপের ‘কেস খা না হলে পাঁচশো টাকার নোট ভাঙিয়ে দিয়ে যা, শা…’ শুনে ওই প্রবাদ বাক্যটা আরও একবার ঝালিয়ে নেওয়া গেল, ‘রক্ষকই ভক্ষক’!
তথ্য সহায়তা: বিদীপ্তা বিশ্বাস।
আরও পড়ুন, নোটের আকালে বন্ধ হল স্পট ফাইন
ব্যাঙ্ক নেই, এটিএম নেই, নোট দুর্গত এলেহারদের আর্তি, ‘আমরা কি মরব?’