কলকাতার রমেশ দত্ত স্ট্রিটে তৈরি হওয়া শিরদাঁড়া। ছবি: সুমন বল্লভ।
আরজি কর-কাণ্ডের আবহে পুজোর থিম হিসাবে সেই ‘শিরদাঁড়া’ নিয়ে যত বিপদ! আপত্তি ওঠায় নানা প্যান্ডেলের শিরদাঁড়ার মডেল কোথাও ঠাঁই পাচ্ছে আস্তাকুঁড়ে, কোথাও আবার ঢেকে রাখা হচ্ছে ত্রিপল দিয়ে।
কবি শ্রীজাত লিখেছিলেন, ‘তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়’। এ বারের পুজোয় প্রতীকী শিরদাঁড়াকে থিম করে মণ্ডপসজ্জার কথা ভেবেছিল শহর ও শহরতলির কয়েকটি পুজো কমিটি। তার মধ্যে যেমন রয়েছে বেলেঘাটার গান্ধী মাঠ ফ্রেন্ডস সার্কল, কেষ্টপুরের মাস্টারদা স্মৃতি সঙ্ঘ এবং হাওড়ার সাঁতরাগাছি কল্পতরু স্পোর্টিং ক্লাব। কিন্তু শিরদাঁড়া নিয়ে বিতর্কের আবহে বেলেঘাটার পুজোর সেই শিরদাঁড়া মডেলের ঠাঁই হয়েছে মণ্ডপের পিছনে আবর্জনার স্তূপে। অন্য দিকে, হাওড়ার পুজোর শিরদাঁড়া মডেল ঢাকা পড়ল ত্রিপলে।
বেলেঘাটা গান্ধী মাঠ ফ্রেন্ডস সার্কলের এ বছর ৫১তম পুজো। তাদের পুজোর থিম— ‘পরিবারের মেরুদণ্ড বাবা’। উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, বাবা পরিবারের কর্তা। পরিবারের মেরুদণ্ডসম। কিন্তু বাবারা বরাবর অন্তরালেই থেকে যান। তাই এ বারের পুজো তাঁদেরই উৎসর্গ করা হচ্ছে। তার জন্য একটি বিশাল শিরদাঁড়া তৈরিও করা হয়েছিল। তা প্রদর্শনের কথা ছিল মণ্ডপের সামনেই। কিন্তু আরজি কর-কাণ্ডের আবহে সেই মেরুদণ্ড বা শিরদাঁড়া থিম নিয়ে বিতর্ক বাধে। প্রশ্ন ওঠে, পরিবারের পুরুষকর্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর নামে শিরদাঁড়া প্রদর্শন করে কি অন্য কোনও বার্তা দেওয়া হচ্ছে? বিতর্ক দানা বাঁধতেই সেই প্রতীকী শিরদাঁড়া সরিয়ে দেওয়া হয় মণ্ডপ থেকে। হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত বদল? এ বিষয়ে পুজো উদ্যোক্তাদের তরফে স্পষ্ট উত্তর কোনও মেলেনি। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে যে, শাসকদলের চাপেই হয়তো শিরদাঁড়া মডেল সরিয়ে ফেলেছেন উদ্যোক্তারা। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও বিবৃতি প্রকাশ্যে আসেনি। জুতসই জবাব মেলেনি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকেও।
অন্য দিকে, এ বার ৪১তম বর্ষে পা দিয়েছে সাঁতরাগাছি কল্পতরু স্পোর্টিং ক্লাবের পুজো। তাদের পুজোর থিম বাস্তবতা। মণ্ডপে ঢোকার মুখেই তৈরি করা হয়েছে ২০ ফুট লম্বা প্রতীকী শিরদাঁড়া। প্রতিবাদের প্রতীক হিসাবে পুজোর মণ্ডপে ব্যবহার করা হয়েছে মানুষের মেরুদণ্ড। সঙ্গে মণ্ডপের গায়ে লেখা, ‘মা আমি ডাক্তার হতে পারলাম না’। মা দুর্গার হাতে অস্ত্রের বদলে থাকছে আয়না। মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে এই প্রতীকী আয়না ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্পী সৌরভ ঘোষ। পুজো উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, এক চিকিৎসকের স্বপ্নকে বোঝাতে প্যান্ডেল জুড়ে মুখ বাঁধা ছোট ছোট থলি ব্যবহার করা হয়েছে। যে স্বপ্ন প্রতি দিন বাস্তবতার আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, অন্যায় দেখে মানুষের নির্লিপ্ততা বোঝাতে ছোট ছোট মূর্তির চোখে কালো কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে। সোমবার সেই প্যান্ডেলে ঢোকার মুখেই বসানো হয়েছিল শিরদাঁড়া। পুজো কমিটি সূত্রে খবর, সেই শিরদাঁড়ার ছবি প্রকাশ্যে আসার পরেই মণ্ডপে পুলিশ আসে। তার পরেই ঢেকে ফেলা হয় শিরদাঁড়ার মডেল। উদ্যোক্তাদেরও পুলিশ তলব করেছে বলে সূত্রের খবর। যদিও পুলিশের তরফে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
শ্রীজাতের কবিতার সূত্র ধরেই ‘শিরদাঁড়া’ শব্দটি এক সময়ে বিস্তর হইচই হয়েছিল। আরজি কর-কাণ্ডের আবহে সেই শিরদাঁড়ার অনুষঙ্গ বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। শিরদাঁড়ার প্রসঙ্গ এসেছে সাহসিকতার প্রতিরূপ হিসাবে। প্রতীকী শিরদাঁড়া নিয়ে মিছিল করেছিলেন চিকিৎসকেরা। শুধু তা-ই নয়, কলকাতার সদ্য প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকেও চিকিৎসকেরা শিরদাঁড়া উপহার দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে, চিকিৎসকের আন্দোলনের চাপেই বিনীতকে কলকাতার কমিশনার পদ থেকে সরিয়ে দেয় রাজ্য সরকার। পুজোর থিমেও সেই শিরদাঁড়া নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে।