কলকাতা পুলিশের এই ইনসিডেন্ট রিপোর্ট ঘিরেই বিতর্ক।
আলিপুর আদালতের বাইরে আইনজীবীর হাত ধরে কাঁদতে কাদতে বৃদ্ধা বারবার বলছেন, ‘‘আপনারা আমায় বাঁচিয়েছেন। বিচারক ভগবান।’’ ছেলের মৃত্যুর পরে বিমার টাকা পেতে হয়রানির চূড়ান্ত হওয়া মানিকতলা ক্যানাল ইস্ট রোডের এই বাসিন্দা নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। হাত জোড় করে বলেছেন, ‘‘অনেক কষ্ট করে ক’টা টাকা পেয়েছি। সামনে মেয়ের বিয়ে। থানা-পুলিশ আর নয়।’’
বৃদ্ধা জানান, গত অক্টোবরে ইএম বাইপাসে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে পেশায় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভ তাঁর ছেলের। মা, বোনের সংসারে পঁচিশের সেই তরুণই ছিলেন একমাত্র রোজগেরে। গত জানুয়ারিতেই বোনের বিয়েও ঠিক হয়েছিল। হঠাৎ ওলটপালট হয়ে যায় সব কিছু। তার থেকেও বেশি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় পুলিশের রিপোর্ট। শুক্রবার বৃদ্ধা বলেন, ‘‘ছেলে হেলমেট ছাড়া বাইক চালাত না। দুর্ঘটনার দিনেও মাথায় হেলমেট ছিল। অথচ, পুলিশ সেই সময়ে রিপোর্টে বলেছিল, ছেলের মাথায় হেলমেট ছিল না। তার জেরে বিমা কোম্পানি বলছিল, হেলমেট ছাড়া দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই বিমার টাকা দেবে না।’’
বৃদ্ধার আইনজীবী জানান, চার্জশিটে পুলিশ পরে জানিয়েছিল তরুণটির মাথায় হেলমেট থাকার কথা। শেষমেশ বিচারক সেই চার্জশিটের উপরে ভিত্তি করেই বিমার পক্ষে রায় দেন। বৃদ্ধা বিমার টাকা পান। গত ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত ওই রায়ের আগে থানা-পুলিশ এবং আদালতে ঘুরে বৃদ্ধার জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে গিয়েছিল। আটকে যায় মেয়ের বিয়েও।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কোনটি সঠিক রিপোর্ট?
আইনজীবীদের একটি অংশ জানান, পুলিশের এমন ভুল রিপোর্টের জন্য বহু পরিবারকেই ভুগতে হয়। কখনও থানা ভুল করে। কখনও কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজার। বৃহস্পতিবারই লালবাজারের প্রকাশিত ইনসিডেন্ট রিপোর্ট’ তেমনই নমুনা মিলেছে।
কী ভুল?
ওই দিন লালবাজার জানায়, বুধবার রাতে টালা সেতুর উপরে হেলমেটহীন দুই মোটরবাইক আরোহীর দুর্ঘটনা ঘটে। তাতে অনীশ বিশ্বাস নামে এক আরোহীর মৃত্যু হয়। অথচ, ঘটনাটি যে ট্র্যাফিক গার্ড এলাকায় ঘটেছে সেখানে ফোন করলে এক আধিকারক বলেন, ‘‘মাথায় দামী হেলমেট ছিল।’’
দুই ধরনের রিপোর্ট কেন? কোনটি ঠিক?
এই ব্যাখ্যা চাওয়া হলে বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২২ নাগাদ পুলিশের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে নতুন ‘ইনসিডেন্ট রিপোর্ট’ প্রকাশ করে লালবাজার। তাতে লেখা হয়, ‘ছোট্ট সংশোধনের পরে নতুন করে পোস্ট করা হল। এই ঘটনায় আরোহীদের মাথায় হেলমেট ছিল।’
আলিপুর আদালতের আইনজীবী দীপককুমার দাস বলছেন, ‘‘এমন ভুল রিপোর্ট হলে বিমার টাকা পাওয়াই অসম্ভব হয়ে যায় মৃতের পরিবারের। আদালত বলতে পারে, নিজের গাফিলতিতেই যুবক বিপদে পড়েছেন। বিমা সংস্থাও সহজেই দায় এড়িয়ে যাবে।’’ দীপকবাবু জানান, প্রয়োজনীয় নথি-সহ বিমার টাকা পেতে মামলা করলে পুলিশি রিপোর্ট, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখে বিচারক দুর্ঘটনাগ্রস্ত পরিবারকে টাকা দেওয়ার জন্য বিমা সংস্থাকে নির্দেশ দিতে পারেন। ‘‘তবে চালক হেলমেট ছাড়া বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলেন প্রমাণ হলে টাকা পাওয়া কার্যত অসম্ভব।’’ বলেন দীপকবাবু।
বৃহস্পতিবার রাতের ভুল প্রসঙ্গে কথা বলতে ফোন করা হলে কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (১) জাভেদ শামিম বলেন, ‘‘ডিসি ট্র্যাফিক বলতে পারবেন।’’ ডিসি ট্র্যাফিক সন্তোষ পাণ্ডে বলেন, ‘‘থানা থেকে যে এফআইআর করা হচ্ছে, তাতে কী লেখা হচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।’’