প্রতীকী চিত্র।
অসংগঠিত শ্রমিকের স্বীকৃতির দাবি যৌনকর্মীরা জানিয়ে আসছেন বহু দিন থেকেই। এ বার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো পরামর্শে (অ্যাডভাইসরি) সেই একই কথা বলেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে গণ্য করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে বর্তমান অতিমারি পরিস্থিতিতে যৌনকর্মীদের আর্থিক সঙ্কট কিছুটা কাটতে পারে বলে জানানো হয়েছে ওই অ্যাডভাইসরিতে। যদিও ইতিমধ্যেই এ নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে বিতর্ক।
করোনা আবহে দেশে লকডাউনের সময় থেকেই ছোঁয়াচ এড়াতে বন্ধ যৌনপল্লিগুলি। লকডাউনের পরে বিভিন্ন যৌনপল্লির এখনও প্রায় তালাবন্দি দশা। এমন পরিস্থিতিতে যৌনকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের পুরনো দাবিকেই মান্যতা দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। ওই অ্যাডভাইসরিতে দাবি করা হয়েছে, যৌনকর্মীদের অসংগঠিত শ্রমিকের তকমা দিলে এই করোনা-কালে তাঁদের আর্থিক দুরবস্থার কিছুটা সুরাহা হবে।
তবে মানব পাচার রোধে কাজ করা অনেকেই এর সমালোচনা করেছেন। এর ফলে পাচারকারীদের সুবিধা হবে বলেও মনে করছেন অনেকে। অন্ধ্রপ্রদেশের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে সুনীতা কৃষ্ণন বলছেন, ‘‘এই অ্যাডভাইসরি ভারত সরকারের নীতি এবং মানবাধিকারের বিরুদ্ধে।’’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, গত ২৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় কোনও মেয়েকেই তিনি দেখেননি, যিনি স্বেচ্ছায় কোনও যৌনপল্লিতে এসেছেন। অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক কারণে জোর করে এই পেশায় নামতে বাধ্য করা হয়েছে মেয়েদের। তাই করোনা আবহে
যৌনকর্মীদের সুযোগ দেওয়ার নামে এই পেশাকে আইনি বৈধতা দেওয়ার বিরোধিতা করছেন তিনি। এর ফলে মেয়েদের উপরে শোষণ এবং অত্যাচার বাড়বে বলেই মনে করছেন সুনীতা। এর বদলে যৌনকর্মীদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তথা পাচার রোধে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান রবিকান্ত জানাচ্ছেন, তাঁরা যৌনকর্মীদের সুযোগ-সুবিধার বিরোধিতা করছেন না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যৌনকর্মীদের রেশন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সুবিধা আবশ্যিক করুক। কিন্তু যৌনকর্মীদের অসংগঠিত শ্রমিক বলা মানে যৌন পেশাকে আইনি ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া। ফলে নাবালিকাদের যৌন পেশায় টেনে আনার প্রবণতা এবং পাচার দুটোই আরও বাড়বে বলেই মত রবিকান্তের। তিনি এ বিষয়ে ২০১২ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের কথাও মনে করিয়েছেন। যেখানে বলা হয়েছে, যৌনকর্মীদের সুযোগ-সুবিধা বা পুনর্বাসন দেওয়া হোক, কিন্তু এই পেশাকে আইনত স্বীকৃতি দেওয়া ঠিক নয়।
সোনাগাছিতে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অবশ্য এই অ্যাডভাইসরিকে স্বাগত জানিয়েছে। ওই সংস্থার প্রধান স্মরজিৎ জানা বলেন, ‘‘এই অ্যাডভাইসরি কখনওই পাচারকারীদের সুবিধা করে দেবে না।’’ তাঁর দাবি, তাঁর সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত যৌনকর্মীদের প্রত্যেকে উপার্জন করতেই এই পেশায় এসেছেন। কিন্তু আর্থিক কারণেই কি তাঁরা এই পেশায় নামতে বাধ্য হননি? স্মরজিৎবাবু বলছেন, ‘‘যাঁরা বেশি পড়াশোনা করেননি, সেই মহিলারা তিন ধরনের পেশায় আসেন— পরিচারিকা, জোগাড়ে বা যৌনকর্মী। তাঁরা তো জেনে আসছেন যে কী কাজ তাঁদের করতে হবে!’’
সত্যিই কি স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসেন মেয়েরা? সোনাগাছির এক যৌনকর্মী সীমা দে জানাচ্ছেন, স্বেচ্ছায় প্রায় ২০ বছর আগে এই পেশায় এলেও আসল কারণ ছিল আর্থিক দুরবস্থা। তাই সংসার চালাতে এই পেশাকেই বেছে নিয়েছিলেন। উত্তর ২৪ পরগনা থেকে পুণের যৌনপল্লিতে পাচার হয়ে গিয়েছিলেন সারিকা খাতুন। উদ্ধার হওয়ার পরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালানো এই তরুণী বলছেন, ‘‘এই পেশায় কেউ স্বেচ্ছায় আসে না। কাজের লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে জোর করে নামানো হয়। তখন বাধ্য হয়েই থেকে যায় অনেকে।’’