ফাইল চিত্র।
বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের মতবিরোধ অব্যাহত। করোনা সংক্রমণ নিয়েও সে বিরোধ সমানে চলছে। কিন্তু এ বার ‘বিরোধ’-এর কেন্দ্রে আদিগঙ্গা!
রাজ্যের দাবি, আদিগঙ্গা সংস্কারের জন্য নিকাশি পরিশোধন প্লান্ট তৈরি করা খুবই প্রয়োজন। যাতে পুর এলাকার তরল বর্জ্য সরাসরি আদিগঙ্গায় না পড়ে। কিন্তু সেই প্লান্ট তৈরির প্রাপ্য পুরো টাকা কেন্দ্র দিচ্ছে না। উল্টে নানা রকম শর্ত আরোপ করছে। কেন্দ্রের পাল্টা দাবি, কোনও শর্তই দেওয়া হয়নি। শুধু নিকাশি পরিশোধন প্লান্ট তৈরির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যে বিষয়গুলি মেনে চলা প্রয়োজন, তা কতটা করা হয়েছে, সেটাই রাজ্যের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০১৭ সালে আদিগঙ্গার দূষণ কমাতে পাম্পিং স্টেশন ও নিকাশি পরিশোধন প্লান্ট তৈরির জন্য কেন্দ্রীয় জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন ও গঙ্গা পুনরুজ্জীবন মন্ত্রকের অধীনে ‘ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা’-র (এনএমজিসি) তরফে ৩০৭.১২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। যার মধ্যে ৮২ ও ৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল যথাক্রমে আদিগঙ্গা পরিষ্কার ও পলি নিষ্কাশনের কাজে। কিন্তু তার পরেই কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ শুরু হয়। দু’বছর পরে, অর্থাৎ ২০১৯ সালে রাজ্য সরকার দাবি করে, দু’বছর আগে টাকা বরাদ্দ হয়ে গেলেও তা এখনও পাওয়া যায়নি। বরং এনএমজিসি একাধিক শর্ত আরোপ করেছে। যেমন, দখলদার সরানো ও তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়া, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা, আদিগঙ্গার দু’পাড় ঘিরে দেওয়া, সৌন্দর্যায়ন করা ইত্যাদি। সেই জট এখনও কাটেনি। প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘আদিগঙ্গা বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে নিকাশি পরিশোধন প্লান্ট তৈরি করা প্রয়োজন। কিন্তু তার পরেও এতগুলি শর্ত আরোপ করা বাস্তবসম্মত নয়।’’
এর পরিপ্রেক্ষিতে এনএমজিসি জানিয়েছে, তারা কোনও শর্তই দেয়নি। কিন্তু যেহেতু প্রকল্পের অর্থ বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছ থেকে নেওয়া হবে, তাই তাদের ‘এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল ম্যানজেমেন্ট প্ল্যান প্রোটোকল’-এর নির্ধারিত মাপকাঠি পূরণ করা প্রয়োজন। সেই মাপকাঠি অনুযায়ী যে কোনও প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সংশ্লিষ্ট এলাকা দখলদারমুক্ত হওয়া ও সেখানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এনএমজিসি-র এক কর্তা জানান, কিন্তু কবে দখলদার সরানো হবে, কী ভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে, এ সংক্রান্ত স্পষ্ট কোনও সময়সীমাই রাজ্য সরকার জানায়নি। কিন্তু আনুষঙ্গিক সমস্যা সমাধানে সম্ভাব্য কত সময় লাগতে পারে, তা না জানলে কোনও সংস্থাই প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখাবে না। ওই কর্তার কথায়, ‘‘যারা দরপত্রে অংশগ্রহণ করবে, তারা তো পুরো পরিস্থিতি ও সেই সংক্রান্ত কী কী ঝুঁকি রয়েছে, তা স্পষ্ট ভাবে জানতে চাইবে। কিন্তু সেটাই তো পরিষ্কার হয়নি এখনও।’’
অথচ ঘটনাপ্রবাহ বলছে, চার বছর আগেই এনএমজিসি প্রকল্পে আদিগঙ্গা সংস্কারের কাজকে যুক্ত করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প রূপায়ণের ‘স্টেট প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ’-এর তরফে আদিগঙ্গার একাংশ দূষণমুক্ত করতে বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্টও তৈরি করা হয়। কলকাতা পুরসভাও আদিগঙ্গা দূষণমুক্ত করার প্রকল্প এনএমজিসি-র কাছে জমা দেয়। কিন্তু তার মধ্যেই একটি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ঘটনা ঘটে। আদিগঙ্গার অবস্থা সরেজমিন দেখতে আসে জাতীয় পরিবেশ আদালতের প্রতিনিধিদল। পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে বর্জ্য পড়ে আদিগঙ্গার বুজে আসা, দখলদার সরানো-সহ একাধিক সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেয় আদালত।
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, তার পরেও আদিগঙ্গা রয়ে গিয়েছে আদিগঙ্গাতেই! বরং ক্রমশ তা আরও বুজে এসেছে। জাতীয় পরিবেশ আদালত সম্প্রতি পাঁচ বছর ধরে চলা আদিগঙ্গা মামলার নিষ্পত্তি করে কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’পক্ষকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে বলেছে। সংশ্লিষ্ট মামলায় আদালতবান্ধব হিসেবে নিযুক্ত পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘গত পাঁচ বছরে শুধু অজস্র চিঠি, ফাইল চালাচলি হয়েছে, কিন্তু আদিগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করা যায়নি!’’