অ্যাসিড হামলার আগে এবং পরে সূর্যশঙ্কর বারিক। নিজস্ব চিত্র
এক বার নয়। মুখ-শরীরে অ্যাসিডের দহন ঢাকতে কয়েক দফায় একাধিক বার অস্ত্রোপচার করতে হয় আক্রান্তদের। না হলে সেই ক্ষত বয়ে নিয়ে চলতে হয় জীবনভর। অথচ শাস্তি তো দূর অস্ত্, দিনের পর দিন অবলীলায় তাঁদের চোখের সামনেই বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায় অপরাধীরা। ফলে ক্রমশ বিচার ব্যবস্থার উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন অ্যাসিড আক্রান্তেরা। বিশেষত এ রাজ্যের আক্রান্তেরা। সারা দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অ্যাসিড হামলা এবং অ্যাসিড আক্রমণের চেষ্টার ঘটনায় দেশের মধ্যে এ রাজ্য প্রথম স্থানে থাকলেও এখানে এই অপরাধের শাস্তি শেষ কবে পেয়েছে কোনও অভিযুক্ত, তা অনেকেই মনে করতে পারছেন না।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বুরো-র (এনসিআরবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে যে হারে অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং যত জন আক্রান্ত হয়েছেন, তার তুলনায় শাস্তির হার নগণ্য। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে দেশে অ্যাসিড-হামলায় শাস্তির হার ছিল মাত্র ২.৪৯ শতাংশ। যা ২০১৭ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৩৯ শতাংশ। ২০১৮ সালে সেই শাস্তির হার হয় ৩.৩৬ শতাংশ।
অথচ অ্যাসিড হামলার ঘটনার নিরিখে এক সময়ে বিশ্বে প্রথম স্থানে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ২০০২ সালে এ নিয়ে কড়া আইন প্রণয়ন করে হামলার সংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যেই একেবারে কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এ শহরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে দিব্যালোক রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের ওই আইনানুযায়ী অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনার ৯০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করার কথা বলা আছে। আর কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার নির্দেশ দেওয়া হয়। সরকারি ভাবে কেউ অথবা পুলিশ এই মামলা নিষ্পত্তি করতে দেরি করলে তার বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে। আর এই কারণেই অ্যাসিড হামলা রুখতে সাফল্যের মুখ দেখেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি মহারাষ্ট্র সরকারও যে আইনের খসড়া বানিয়েছে, তাতে ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি এবং দোষী সাব্যস্ত হলে মৃত্যুদণ্ডের কথাও বলা হয়েছে।
আরও খবর: মাথায় চলছে অস্ত্রোপচার, সিন্থেসাইজার বাজাচ্ছে সৌম্যা
কিন্তু অ্যাসিড হামলা রুখতে এ রাজ্যে এখনও এমন কড়া আইন নেই। ফলে অ্যাসিড আক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু হামলাকারীদের শাস্তি হচ্ছে না— এমনটাই জানাচ্ছেন আক্রান্তেরা। যেমন, সাত বছর ধরে অভিযুক্তের শাস্তির আশায় দিন গুনছেন গঙ্গাসাগরের সূর্যশঙ্কর বারিক। পেশায় প্যারা-শিক্ষক সূর্যের থেকে টাকা ধার নিয়েও ফেরত না দেওয়ায় গোলমাল হয়েছিল এক ব্যক্তির সঙ্গে। সেই ‘অপরাধে’ মোটরবাইকে করে এক সঙ্গীকে নিয়ে এসে সূর্যের মুখে অ্যাসিড ছোড়ে সেই ব্যক্তি। এক জন ধরা পড়লেও পালিয়ে যায় মূল অভিযুক্ত। পরে সে আত্মসমর্পণ করলেও সে সময়ে সূর্য হাসপাতালে থাকায় সহজে জামিন পেয়ে যায় সেই অভিযুক্ত। তার পরে কেটে গিয়েছে সাত বছর। সূর্য জানাচ্ছেন, তাঁর অ্যাসিড-ক্ষতের চিকিৎসা এখনও চলছে। এই মামলায় চার্জশিট পেশ হলেও এত দিনে তাঁর সাক্ষ্যই নেওয়া হয়নি। আর সেই সুযোগে সাত বছর ধরে অভিযুক্তেরা বহাল তবিয়তে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
২০০০ সালে শ্বশুরবাড়িতে অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ার পর থেকে কথা বলতে পারেন না নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ঋতা পাল। অভিযুক্ত স্বামী-শাশুড়ি কয়েক বছর জেল খাটলেও পরে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার পরে সেই মামলার কী হল, তা জানানোর জন্য কেউ-ই নেই ঋতার। ২০১৫ সালে অ্যাসিড দহনের শিকার হওয়ার পর থেকে আজও আদালতের চক্কর কাটছেন মনীষা পৈলান। প্রতি বারই দেখতে পান, অভিযুক্তেরা কোর্টে হাজিরা দিয়ে চলে যায়। মনীষার কথায়, “আদালতে গেলে মনে হয় যেন আমিই অপরাধী।”
আরও খবর: ‘দেশের অর্ধেক মানুষ যেখানে অভুক্ত, তখন নতুন সংসদ ভবন কিসের জন্য?’, মোদীকে প্রশ্ন কমল হাসনের
২০১৫ সালের জুন মাসে অ্যাসিড হামলার শিকার হলেও এখনও পারমিতা বেরার মামলার একই পরিণতি। পারমিতা জানাচ্ছেন, ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ধরা পড়ার তিন মাস পরেই জামিন পেয়ে যায়। এখন দিব্যি গুছিয়ে সংসার করছে অভিযুক্ত। অথচ গত পাঁচ ধরে আদালতে মামলার শুনানি চলছে। আর পারমিতা? এমএ পড়ার খরচ চালাতে আপাতত মোমবাতির ব্যবসাটুকুই ভরসা তাঁর। পারমিতার বক্তব্য, “পাঁচ বছর ধরে ঘুরে ঘুরে দেখলাম, কেউ আমাদের জন্য ভাবে না। খালি বড় বড় কথা বলে। তাই ঠিক করেছি মামলার কী হল, তা নিয়ে না ভেবে পড়াশোনা নিয়েই থাকতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।”
কিন্তু কেন অ্যাসিড-মামলায় অপরাধীর শাস্তির হার এত কম? কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে স্বাতী চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এখানে পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি— সকলের সদিচ্ছার অভাবই এর প্রধান কারণ। যদিও হাইকোর্টের আইনজীবী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “হাইকোর্টের নির্দেশ বলছে ছ’মাসের মধ্যে মামলা সম্পূর্ণ করে এর নিষ্পত্তি করতে হবে।’’