রাজ্য জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রচুর। প্রতীকী ছবি।
কখনও আবাসিককে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে। কখনও আবাসিকের মৃত্যুর কারণ জানা যায় না বহু বছরেও। কিছু ক্ষেত্রে আবার জানানো হয়, পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন আবাসিক। অথবা বলা হয়, তিনি নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলেছেন!
রাজ্য জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রচুর। তবু প্রশাসন কোনও কড়া পদক্ষেপ করে না বলে অভিযোগ। কোনও ঘটনা ঘটলে কিছু দিন তা নিয়ে আলোচনা হয়, সরকারি দফতরগুলি কিছু দিন নিজেদের মধ্যে দায় ঠেলাঠেলি করে, তার পরে ফের যে-কে-সেই! কোন লাইসেন্সের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে ওই নেশামুক্তি কেন্দ্র, সেই অনুমতি দেওয়া হয়েছে কিসের ভিত্তিতে— কিছুই জানা যায় না। পুলিশ বলে, ‘‘সমাজকল্যাণ দফতরের বিষয়টি দেখার কথা।’’ আর সমাজকল্যাণ দফতরের জবাব, ‘‘পুলিশ কী করছে?’’ সম্প্রতি বাঁশদ্রোণীর এক নেশামুক্তি কেন্দ্রে ৪১ বছরের এক ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় ফের এমন প্রশ্ন উঠছে।
ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, নেশামুক্তি কেন্দ্র খুলতে লাগে একটি দোতলা বা তেতলা বাড়ি, সেখানে ঝাঁ-চকচকে অফিসঘরে মাদক নিয়ে সচেতনতার প্রচার সংক্রান্ত ইংরেজিতে লেখা পোস্টার বা ছবি। এ ছাড়া প্রয়োজন ইন্টারনেটে সংস্থার নাম-ফোন নম্বরটুকু তুলে দেওয়া এবং সোসাইটি আইনে বেসরকারি সংস্থার রেজিস্ট্রেশন। তার পরেই নেশামুক্তি কেন্দ্র চালু করতে কোনও সমস্যা নেই। এক বার চালু হলে মৌখিক প্রচারেই মাদকাসক্তদের পরিবারের আসা-যাওয়া শুরু হয় সেখানে। মোটামুটি কিছু দিন চালাতে পারলে মিলতেও পারে কেন্দ্রের অনুদান। এর পরে রোগীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা বুঝে টাকা দাবি করতে পারলেই হল! কিন্তু কোথাওই নেশা ছাড়াতে আসা মাদকাসক্তদের সঙ্গে পরিবারকে দেখা করতে দেওয়া হয় না। ভর্তির সময়ে প্রতি সপ্তাহে কথা বলানোর আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে নেশামুক্তি কেন্দ্রের চিকিৎসকের সঙ্গেও কথা বলতে পারে না পরিবার। বলা হয়, ‘‘রোজ দেখা করা যাবে না। অসুস্থ হলে ডাকা হবে।’’
হরিদেবপুরের এক নেশামুক্তি কেন্দ্রে আত্মীয়াকে দীর্ঘদিন রাখার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘ছোট্ট ঘরে ৭-৮ জনকে রাখা হয়। ঘরে একটাই জানলা, মেঝেতে মাদুর পেতে শোওয়ার ব্যবস্থা। দিনে দু’বেলা খেতে দেওয়া হয়, তবে পরিমাণে অল্প। একটাই শৌচাগার, দরজা ভাঙা। রীতিমতো উলঙ্গ করে শারীরিক পরীক্ষা করানো হয়। প্রতিবাদ করলেই মার। অনেকের শিকল দিয়ে হাত বেঁধে রাখা হয়।’’ বাঁশদ্রোণীর একটি নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসা এক ব্যক্তির কথায়, ‘‘পরিবারকে তিন মাস ধরে জানাতেও পারিনি, কী যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে।’’
বাঁশদ্রোণীর যে নেশামুক্তি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, সেখানেও তেতলা ভবনে ছোট ছোট ঘরে ২০-৩০ জনকে রাখা হয়েছে বলে খবর। ওই কেন্দ্রের এক আবাসিকের আত্মীয় (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বললেন, ‘‘যা ঘটেছে, তা শুনে দাদাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি। কিন্তু প্রতিদিন ঘোরানো হচ্ছে। প্রয়োজনে পুলিশে যাব।’’
কিন্তু কে চালাবে নজরদারি? পুলিশ বলে, লাইসেন্স ছাড়া ‘সোসাইটি অ্যাক্ট, ১৯৬১’-এর জোরেই চলছে এই ব্যবসা। সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিকেরা আবার জানাচ্ছেন, নেশামুক্তি কেন্দ্রের অনুমতি দেন না তাঁরা। ‘সোসাইটি অ্যাক্ট, ১৯৬১’-এর ভিত্তিতে এমন কেন্দ্র চালানো যায় না! মানসিক সমস্যায় ভোগা রোগীদের রাখতে প্রয়োজন স্বাস্থ্য দফতরের মেন্টাল হেল্থ লাইসেন্স। সে ক্ষেত্রে নেশাগ্রস্তদের আলাদা রাখা বাধ্যতামূলক। ১৪ ফুট লম্বা, ১২ ফুট চওড়া ঘরে সর্বাধিক তিন জনকে রাখা যাবে। ভবনের জন্য প্রয়োজন দমকলের ছাড়পত্র, ফুড লাইসেন্স। সর্বক্ষণের জন্য এক জন চিকিৎসক, দু’জন নার্স রাখা বাধ্যতামূলক। থাকতে হবে সিসি ক্যামেরার নজরদারিও।
বাস্তবে এর কিছুই থাকে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তা হলে উপায়? কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা শুধু বলেন, ‘‘এ শুধু পুলিশের ব্যাপার নয়। নানা জায়গা থেকে অভিযোগ আসে। প্রশাসনিক শীর্ষ কর্তাদের জানিয়ে পদক্ষেপ করার কথা বলা হবে।’’