Haridevpur Case

দৃষ্টি ক্ষীণতর হলে দরও বেশি, এজেন্ট দিয়েই রমরমা স্কুলের

হরিদেবপুর থানা এলাকার জোকায় দৃষ্টিহীনদের একটি স্কুল তথা হোমে আবাসিকদের ধর্ষণ এবং যৌন নিগ্রহের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খোঁজ করতে সামনে এল এমনই আরও নানা তথ্য।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৫১
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

কলকাতায় নিয়ে আসতে পারলেই বাচ্চাপিছু মেলে ৫০ হাজার টাকা! বয়স পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে হলে মিলতে পারে আরও বেশি। সেই বাচ্চার দৃষ্টিশক্তি কতটা ক্ষীণ, তার উপরে অনেকটা নির্ভর করে দর! জন্ম থেকেই সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হলে চাহিদা খুব বেশি। কিন্তু জন্মের কিছু দিন পর থেকে দৃষ্টি হারানো শুরু হয়েছে মানে ততটা কার্যকর নয়। টাকা পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে ভাগে বিশেষ থাকে না। নানা ‘চ্যানেলে’ বখরার হিসাব মেটাতে মেটাতেই শেষ!

Advertisement

হরিদেবপুর থানা এলাকার জোকায় দৃষ্টিহীনদের একটি স্কুল তথা হোমে আবাসিকদের ধর্ষণ এবং যৌন নিগ্রহের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খোঁজ করতে সামনে এল এমনই আরও নানা তথ্য। জানা গেল, জেলায় জেলায় ছড়িয়ে থাকা এমন স্কুলে বাচ্চা নিয়ে আসার কাজে যুক্ত এজেন্টদের কীর্তি। হরিদেবপুরের ওই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী বললেন, ‘‘প্রতিটি জেলায় স্কুলের তিন জন করে লোক রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্যের সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলিতে এজেন্টের সংখ্যা আরও বেশি। এঁদের এক-এক জনের নীচে রীতিমতো একটা দল কাজ করে। সেই দলের কেউ স্থানীয় হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, কেউ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। অন্য দলের দায়িত্ব থাকে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে খাতির রাখা। কোনও সূত্র থেকে দৃষ্টিহীন কোনও বাচ্চার খোঁজ পাওয়া গেলেই তার বাড়িতে চলে যান প্রধান এজেন্ট। এর পরে রীতিমতো ওই বাচ্চার পরিবার এবং তাদের আর্থিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়া হয়।’’ দিন দশেকের মধ্যেই সেই বাচ্চার রিপোর্ট তৈরি করে এর পরে পাঠানো হয় কলকাতার হোমে।

ধর্ষণের অভিযোগ জানাজানি হওয়ার পরে গিরিডি থেকে হোমের সামনে হাজির হওয়া এক এজেন্ট বলছিলেন, ‘‘২০ বছরে অন্তত ১৭টি বাচ্চা এখানে পাঠিয়েছি। রিপোর্ট পাঠানোর পরে স্কুল থেকে দিদিমণিরা যেতেন। এর পরে বাচ্চার পরিবারকে বোঝানোর দায়িত্ব তাঁদের। আমরা টাকা বুঝে নিয়ে সরে যেতাম। বাচ্চার পরিবার কলকাতায় এসে এমন জমজমাট আয়োজন দেখার পরেও যদি নারাজ ভাব দেখাত, তখন আবার আমরা ঢুকতাম। কিন্তু কখনও তেমন কোনও সমস্যা হয়নি।’’ স্কুল থেকেই ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল বিহারের এক এজেন্টের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘‘প্রধান এজেন্টের ভাগ সব চেয়ে বেশি। যিনি খবর আনছেন আর যিনি সরকারি কর্তাদের সঙ্গে খাতির রেখে ঝামেলা সামলান, এর পরে তাঁদের ভাগ। এমন সব জায়গায় টাকা যায় যে, কোনও সমস্যাই কোনও দিন বাইরে আসে না।’’

Advertisement

খবর বাইরে না যাওয়ার অভিজ্ঞতাই জানিয়েছেন কিছু দিন আগে হরিদেবপুরের ওই স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়া এক তরুণী। ফোনে তিনি বলেন, ‘‘মেয়েদের হস্টেলের তেতলায় উঠে যেতেন স্যর। সেখানকার একটি ঘরে এর পরে পালা করে মেয়েদের ডেকে নেওয়া হত। একাধিক দিন সিঁড়িতে, খাবার জায়গাতেও মেয়েদের ধরে অসভ্যতা করতে দেখেছি স্যরকে। কিন্তু স্কুলের গেটের বাইরে কিছুই যেত না।’’ স্কুল থেকে বেরোনো আর এক তরুণী ফোনে বললেন, ‘‘যে মেয়েদের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ কম, পরিবারে তেমন কেউ নেই— তাদের উপরেই অত্যাচার চলত বেশি। আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে খারাপ কাজ করার পরে কাউকে দু’দিন, কাউকে তিন দিন সেখানেই আটকে রাখা হত। ২০১৬ সালে এ নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করি। কিন্তু কিছুই লাভ হয়নি।’’ ১০ বছর এই স্কুলে কাটানো, জামতাড়ার বাসিন্দা এক তরুণী আবার বললেন, ‘‘আমি তখন চোখে অল্প দেখতে পেতাম। স্যরকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে এক দিদিমণিকে বলে দেওয়ায় আমায় বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল। এমনিতে বিদেশ থেকে লোক দেখতে এলে ভাল খাবার দেওয়া হত। বাকি সময়ে সারা বছর নিরামিষ। প্রতিবাদ করলে চার-পাঁচ দিন আর খাওয়াই জুটত না। বেরিয়ে গিয়ে আমায় নিয়ে আসা এজেন্ট কাকুকে ধরেছিলাম। তিনি বলেন, তোকে ওখানে দিয়ে যে টাকা পেয়েছিলাম সব শেষ। আর তোর দায়িত্ব নিতে পারব না।’’

তবে এ সমস্ত অভিযোগই উড়িয়ে নিজেকে হোমের অন্যতম কর্তা বলে দাবি করা উত্তম দত্ত বলছেন, ‘‘সব মিথ্যা। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা জীবেশ দত্তকে ফাঁসানো হচ্ছে। তা ছাড়া জেলায় এজেন্ট না থাকলে বাচ্চা আসবে কোথা থেকে?’’ সমাজকল্যাণ দফতরের শিশু কল্যাণ সমিতি বা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির কলকাতা জেলার চেয়ারপার্সন মহুয়া শূর রায় যদিও বললেন, “এ সব বিষয় সত্যি হলে যথেষ্ট উদ্বেগের। পুলিশ সবটাই খুঁজে বার করবে, এই আশা।’’ ঘটনার তদন্তভার নিয়েছে লালবাজার। পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা এ দিন বলেন, ‘‘সোমবার জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রয়োজনে নতুন ধারাও যুক্ত হতে পারে।’’ (চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement