গাড়ি চুরি চক্রের পান্ডা প্রতীক ভট্টাচার্য। -নিজস্ব চিত্র।
কথায় আছে গরজ বড় বালাই। নিজেই উদ্যোগী হয়ে চোরাবাজারে পাচার হয়ে যাওয়া তাঁর দু’টি গাড়ির হদিশ জেনে পুলিশকে জানিয়েছিলেন। গন্তব্য শুনেই পুলিশ আধিকারিক ‘আবদার’ করেন, বিমানের টিকিট কেটে দিতে হবে। তাই সই। বিমানের টিকিটও কেটে দিয়েছিলেন গাড়ির মালিক বিজন মণ্ডল। কিন্তু, তার পরও চোরাই গাড়ি উদ্ধারে ‘রাজি’ নয় পুলিশ। অনেক অনুরোধ-উপরোধ, এমনকি কোর্ট-কাছারি দৌড়নোর পরে একই মামলায় দ্বিতীয় এফআইআর করে দায় সারে পুলিশ! রাজ্যের কোনও প্রত্যন্ত এলাকায় নয়, ঘটনাটি ঘটেছে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানায়।
বিজন মণ্ডল বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানা এলাকার মহিষবাথানের বাসিন্দা। ২০১৭ সালে তাঁর দু’টি গাড়ি ভাড়ায় দিয়েছিলেন প্রতীক ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তিকে। কিন্তু, কয়েক দিন পরেই উধাও হয়ে যায় তাঁর দু’টি গাড়ি। খোঁজ খবর নিয়ে তিনি জানতে পারেন, শুধু তাঁর দু’টি গাড়়িই নয়, প্রতীক কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকা থেকে একই ভাবে প্রায় ২০০টি গাড়ি ভাড়ায় নিয়ে অনলাইনে বেচে দিয়েছেন। তিনি আরও জানতে পারেন, তত দিনে মণিপুর এবং নাগাল্যান্ডের চোরাবাজারে পৌঁছে গিয়েছে বেশির ভাগ চোরাই গাড়ি। সেই সময় বিজনও তাঁর গাড়ি চুরির অভিযোগ জানান ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানায়। পুলিশ তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর (১৯/২০১৮) নথিভুক্ত করে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ শেষ পর্যন্ত পাক়ড়াও করে প্রতীক এবং তাঁর এক শাগরেদ বাপি মাঝিকে। প্রতীককে জেরা করেই শুরু হয় চোরাই গাড়ি উদ্ধার। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে খবর, ৬০টিরও বেশি গাড়ি গোয়েন্দারা ইতিমধ্যেই উদ্ধার করেছেন। যদিও তার মধ্যে বিজনের একটি গাড়িও নেই।
কলকাতা পুলিশ উদ্যোগ নিলেও, প্রতীকের বেচে দেওয়া চোরাই গাড়ি উদ্ধারে আদৌ উদ্যোগী হয়নি বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট, এমনটাই অভিযোগ। বিজনবাবুর অভিযোগ, ‘‘প্রতীক গ্রেফতার হওয়ার পর ফের আমি থানায় যাই। তদন্তকারী আধিকারিককে অনুরোধ করি আমার গাড়ি দু’টির খোঁজ করতে। কিন্তু পুলিশ কোনও চেষ্টাই করেনি।” তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘আমি নিজের চেষ্টায় বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর করে জানতে পারি, মণিপুরের চূড়াচাঁদপুরের এক ব্যক্তি আমার চুরি যাওয়া একটি গাড়ি কিনে চালাচ্ছেন। আমি নিজে সেই ব্যাক্তির নাম ঠিকানা এমনকি ফোন নম্বরও জোগাড় করে পুলিশকে দিই। সমস্ত কিছু পুলিশকে দেওয়ার পর আমাকে তদন্তকারী আধিকারিক বলেন বিমানের টিকিট কাটতে। তিনি একা যেতে রাজি হননি। আমাকেও যেতে বলেন। তাই দু’জনের টিকিট কাটা হয়। ওখানে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় খরচও আমাকে দিতে বলা হয়। তাতেও আমি রাজি হই। কিন্তু শেষ মূহূর্তে যেতে নারাজ হন ওই পুলিশ আধিকারিক।”
আরও পড়ুন: জেরা করতে ডাকলেও শারীরিক পরীক্ষা, সিঁথি-কাণ্ডের পর লালবাজারের নির্দেশিকা
অভিযোগ, উল্টে বিজনবাবুকে পুলিশ বোঝাতে চায় যে, ওই গাড়ি ফেরত এনে কোনও লাভ নেই। ভাঙাচোরা গাড়ি ফেরত আসবে। তাই কার্যত গাড়ির আশা ছেড়ে দিতেই বলা হয় বিজনবাবুকে। পুলিশ কোনও ভাবে গাড়ি উদ্ধার করছে না দেখে কলকাতা হাইকোর্টে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার মামলা করেন বিজন। সেই মামলার এখনও শুনানি চলছে। তার মধ্যেই বিজনবাবুকে ডেকে ফের প্রতীক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে নতুন একটি এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ। বিজনের কথায়, ‘‘গাড়ির বিমা সংস্থার কাছে গেলে তাঁরা আমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, আদালতে প্রতীকের মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিমার টাকা পাওয়া যাবে না। অন্য দিকে দু’টি গাড়ি মিলিয়ে আমার প্রায় আড়াই লাখ টাকা ঋণের কিস্তি বাকি।”
আরও পড়ুন: চাবি গ্রাহকের কাছে, গড়িয়াহাটে লকার থেকে উধাও ৩০০ গ্রাম সোনার গয়না!
গোটা ঘটনা শুনে রীতিমতো বিস্মিত আইনজীবী অনির্বাণ গুহ ঠাকুরতা। তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, একই অপরাধের ঘটনায় দু’টি এফআইআর হয় না। সে ক্ষেত্রে একই গাড়ি চুরির ঘটনায় কী ভাবে ওই থানার পুলিশ আরও একটি এফআইআর করল?” সর্বোপরি, যে অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ (প্রতারণা), ৪০৬ (চুক্তিভঙ্গ) এবং ১২০বি (অপরাধ মূলক ষড়যন্ত্র) ধারায় মামলা শুরু করেছে পুলিশ, সেই অভিযোগপত্রে কোথাও এফআইআর করতে অনুরোধ করা হয়নি। সেখানে বিজনবাবু পুরনো এফআইআরের উল্লেখ করে চোরাই গাড়িগুলি উদ্ধার করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
গোটা বিষয় নিয়ে ওই থানার আধিকারিকরা কোনও মন্তব্য করতে না চাইলেও, বিধাননগর কমিশনারেটের এক ডিসি পদমর্যাদার আধিকারিক বলেন, ‘‘গোটা বিষয়টা খবর নিয়ে তবেই মন্তব্য করতে পারব। কারণ, বিষয়টি আমার জানা নেই।”