বিরতি: তপ্ত দিনে অনুশীলনের ফাঁকে ঘন ঘন জল খাচ্ছেন ক্রিকেটারেরা। মঙ্গলবার, ময়দানে। —নিজস্ব চিত্র।
চাঁদিফাটা গরমে ম্যাচ চলছে। বলের পিছনে ছোটার সময়ে হঠাৎ পড়ে গিয়েছিলেন এক তরুণ। কয়েক মিনিট পরেও উঠলেন না। যা দেখে খেলা থামিয়ে সেই খেলোয়াড়ের কাছে গিয়ে চিৎকার শুরু করলেন সাইডলাইনের ধারে বসে থাকা এক ব্যক্তি। মুহূর্তে মাঠের পরিবেশ বদলে গেল। কয়েক জন মিলে সেই তরুণকে ধরাধরি করে ট্যাক্সিতে তুলে দ্রুত ছুটলেন হাসপাতালের দিকে!
মঙ্গলবার দুপুরে সিএবি-র (ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল) দ্বিতীয় ডিভিশনের ম্যাচ চলাকালীন ময়দানের এই ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। চলতি এপ্রিলে খেলতে নেমে এ ভাবে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলে খবর। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না। তীব্র গরমে যেখানে পথে বেরোলেই ঘেমে স্নান করে যেতে হচ্ছে, পাখার নীচে ছাড়া বসা যাচ্ছে না, সেখানে ময়দান জুড়ে রমরমিয়ে চলছে ক্রিকেটের আসর। অতীতে একাধিক ঘটনায় ক্রিকেটারদের মৃত্যু ঘটলেও খেলার সময় বদল করার ভাবনাচিন্তা কারও মধ্যেই দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ। উল্টে এমন সময়ে প্রশিক্ষণ বা ম্যাচ ফেলা হচ্ছে, যখন সূর্য সম্পূর্ণ মাথার উপরে থাকে। যদিও সিএবি-কর্তাদের দাবি, সাধারণ মানুষের চেয়ে খেলোয়াড়েরা অনেক বেশি সমর্থ। ফলে, চিন্তার কিছু নেই।
যদিও গরমে খেলা চলাকালীনই দুই উঠতি ক্রিকেটারের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে কলকাতায়। ২০১৯ সালে উত্তর কলকাতার পাইকপাড়া মাঠে পাইকপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে অনুশীলন ম্যাচে হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বছর একুশের অনিকেত শর্মা। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। জানানো হয়, হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই মৃত্যু। একই ভাবে মৃত্যু হয় সিএবি-র দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব বালিগঞ্জ স্পোর্টিংয়ের ক্রিকেটার, একবালপুরের সোনু যাদবের। বাটার মাঠে ব্যাটিং করে আসার পরে অজ্ঞান হয়ে পড়েন সোনু। মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর পরে ফের সংজ্ঞা হারান। তাঁকে সিএবি-র মেডিক্যাল ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে এসএসকেএমে রেফার করা হয়। কিন্তু, বাঁচানো যায়নি।
ময়দানে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব এবং বাটা স্পোর্টস ক্লাবের দ্বিতীয় ডিভিশনের নকআউট খেলা চলাকালীন এক খেলোয়াড়ের অভিভাবক এ বিষয়ে বললেন, ‘‘কিছু বলতে গেলেই বলা হয়, গরমে আইপিএল-ও তো চলছে। কিন্তু ওই ধরনের টুর্নামেন্টে যে ব্যবস্থাপনা থাকে, সেটা এখানে কোথায়? মাঠে কোনও চিকিৎসক থাকেন না। ময়দানের সব ক’টি মাঠের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স রাখা থাকে মাত্র একটি। একাধিক ঘটনা ঘটে গেলে অনেককে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে কী হবে?’’ ময়দানের আর একটি জায়গায় প্রশিক্ষণের মধ্যেই এক প্রশিক্ষকের মন্তব্য, ‘‘সিএবি-তে আর একটি অ্যাম্বুল্যান্স রাখা থাকে। কিন্তু সিএবি-র মেডিক্যাল ইউনিটে চোট-আঘাতের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও জীবনদায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাই রেফার করতে হয়। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যেতেই তো মূল্যবান সময় পেরিয়ে যায়!’’
হৃদ্রোগ চিকিৎসক বিশ্বকেশ মজুমদার বললেন, ‘‘হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে প্রথম এক ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে ঠিকঠাক চিকিৎসা পেলে বিপদ এড়ানো যায়।’’ তাঁর পরামর্শ, গরমে শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রায় গোলমাল হয়। শরীর জলশূন্য (ডিহাইড্রেশন) হয়ে কাহিল হতে পারে। কিডনির অসুখ রয়েছে যাঁদের, তাঁদের হৃদ্যন্ত্রে প্রভাব পড়তে পারে বেশি। তাই গরমে শরীরে জলের মাত্রা ঠিক রাখতে হবে। সেই সঙ্গে এত গরমে খেলার আয়োজন করতে হলে মাঠে অবশ্যই চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘খেলোয়াড়দের রুটিন চেক-আপের মধ্যে থাকা অত্যন্ত জরুরি। অন্তত ইসিজি, ইকো করিয়ে রাখা অবশ্যই দরকার।’’
সিএবি-র মেডিক্যাল ইউনিটের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘মাঠগুলিতে পর্যবেক্ষক থাকেন। সমস্যা হলেই আমাদের জানানো হয়। সিএবি-র সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালের কথা বলা রয়েছে। সেখানে তো বটেই, আশপাশের যে কোনও হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে।’’ সিএবি-কর্তা নরেশ ওঝার বক্তব্য, ‘‘পর্যবেক্ষক এবং আম্পায়ারদেরই আমরা ‘সিপিআর’ (কার্ডিয়ো-পালমোনারি রিসাসিটেশন) প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তবে, খেলোয়াড়দের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পার্থক্য হল, খেলোয়াড়েরা গরমে খেলতেই অভ্যস্ত। যেটা সাধারণ মানুষ নন।’’