যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। —ফাইল চিত্র।
যাদবপুর আছে যাদবপুরেই! ঠিক ১৪ মাস আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে র্যাগিংয়ের জেরে মৃত্যু হয়েছিল এক ছাত্রের। সেই মৃত ছাত্রটির মতো অবস্থা
তাঁরও করা হবে বলে হুমকি দিয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। রাজ্য জুড়ে ডাক্তারদের নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ‘হুমকি-প্রথা’র আবহে যাদবপুরে সঙ্কটের ছায়াটিও তাতে অটুট বলে মনে
করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মীর পুত্র ওই ছাত্র শিক্ষাঙ্গনের ভিতরের কর্মী আবাসনে থাকেন। পুজোর ছুটির ঠিক আগে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কয়েক জন অগ্রজের হাতে তাঁর মারধর খাওয়ার ঘটনা শিক্ষাঙ্গনের নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।
গত বছর মেন হস্টেলে প্রথম বর্ষের নবাগত এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় অভ্যন্তরীণ তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ছাত্রদের শাস্তি দিতে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ যাদবপুর কর্তৃপক্ষ। এমনকি, ওই ছাত্রদের হস্টেল-ছাড়া করার পদক্ষেপেও আপাতত স্থগিতাদেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। এই পটভূমিতে প্রথম বর্ষের ছেলেটিকে কয়েক জন ‘দুর্বৃত্ত’ ছাত্রের মারধরে খাস শিক্ষাঙ্গনের অন্দরে এক ধরনের ‘দাদাতন্ত্র’-এর আভাস ফুটে উঠছে বলেই যাদবপুরের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের একাংশের অভিমত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (জুটা) তরফে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য পরিবেশে নিরাপত্তার দৈন্য দশা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অন্তর্বর্তী উপাচার্য ভাস্কর গুপ্তকে চিঠি দেওয়া হয়। তার পরের সন্ধ্যাতেই আক্রান্ত হন রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষাকর্মীর পুত্র, প্রথম বর্ষের ওই তরুণ। তিনি ইতিমধ্যে যাদবপুর থানায় অভিযোগ জানানো ছাড়াও অন্তর্বর্তী উপাচার্য ও তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রধানের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন।
যাদবপুর থানার তরফে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দুই ছাত্র এবং আরও কয়েক জনের নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১১৮, ১২৬ (২) প্রভৃতি ধারায় প্রথম বর্ষের ছাত্রটিকে আটকে রেখে গুরুতর আঘাতের অভিযোগ নথিবদ্ধ করা হয়। ওই ছাত্রের মাথার পিছনে আঘাত লাগে বলে অভিযোগ। তাঁর বক্তব্য, সিভিল এবং কেমিক্যালের দুই পান্ডা ছাড়াও মেন হস্টেলের আরও কয়েক জন ওই হামলার ঘটনায় জড়িত। তবে, অভিযোগটুকু লেখা ছাড়া এখনও পর্যন্ত কিছুই করেনি পুলিশ। কার্যত নড়ে বসেননি যাদবপুর কর্তৃপক্ষও। স্থানীয় থানার বক্তব্য, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ এলেই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হবে।
নবাগতদের নিরাপত্তা দিতে মেন হস্টেল থেকে সরিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষকে শিক্ষাঙ্গনের ভিতরের হস্টেলে রাখার বন্দোবস্ত করছেন যাদবপুর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ক্যাম্পাসই ক্রমে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ। অভিযোগকারী তরুণ এবং তাঁর দাদা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন ছাত্রের সঙ্গে কর্মী আবাসনের বাসিন্দাদের গোলমাল লেগেই থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কয়েক জন ছাত্র শিক্ষাঙ্গনে মাদক সেবনের জন্য কর্মী আবাসনের বাসিন্দাদের থেকে কার্যত তোলাবাজি করে টাকাও তোলেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর মিলনদার ক্যান্টিনের সামনে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কয়েক জন ছাত্র কর্মী আবাসনের কয়েক জনের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়ালে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্রটি প্রতিবাদ করেছিলেন। ওই তরুণের দাদার মোমোর দোকান রয়েছে চার নম্বর গেটের বাইরে। তিনি বলেন, ‘‘মেন হস্টেলের নিহত ছেলেটির মতো অবস্থা করা হবে বলে আমার ভাইকে তখন থেকেই হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’’ এর পরে ১ অক্টোবর সন্ধ্যায় চার নম্বর গেটেই তাঁর ভাইকে মারধর করে ফেটসু-র ইউনিয়ন রুমে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসি ক্যামেরার ফুটেজেও তার তথ্যপ্রমাণ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর।
শিক্ষাঙ্গনের সান্ধ্য পরিবেশ নিয়ে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি মানছেন জুটা-র সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায়। শিক্ষকদের অভিযোগ, ছাত্রদের একাংশের দৌরাত্ম্য ছাড়াও রাত ৮টার পরে বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নেই। অবাধ মাদক সেবনেই গোলমাল বাড়ছে। অভিযোগকারী তরুণ বলছেন, ‘‘এখনও শাসানি থামেনি। ছাত্রেরা আন্দোলন করে আমার বাবার চাকরি খেয়ে নেবে বলে এখনও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’’
যাদবপুরের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু বলেন, ‘‘পুজোর ছুটিতে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাকর্মী বেশি নেই। এখনই পদক্ষেপ করা মুশকিল।’’ অন্তর্বর্তী উপাচার্যও বলেন, ‘‘যা করার, পুজোর ছুটির পরেই করা হবে।’’ তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচকানাচে ছাত্রদের একাংশ এবং বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে কী করছেন যাদবপুর কর্তৃপক্ষ? এর কোনও সদুত্তর মেলেনি। আগামী সোমবার, পুজোর ছুটির পরে খুলছে যাদবপুর। অল্প কিছু ছাত্রের জন্য যাদবপুরের ভাবমূর্তি ধ্বস্ত হচ্ছে বলে শিক্ষকদের আক্ষেপ।