ঘরহারাদের বরণের শপথ বছর শেষে

মঙ্গলবার, বর্ষবরণের রাতের অন্তরঙ্গ পরিসরের জমায়েতেও নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ক্ষোভ-প্রতিবাদের ছোঁয়াচ। তা থেকেই সঙ্কল্পের জন্ম।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২০ ০১:১৩
Share:

ফাইল চিত্র।

‘‘জানিস, আমাদের কালীঘাটের ‘লালবাতি’ এলাকায় কিছু শয়তান লোক কোনও কোনও মেয়েকে ভয় দেখাচ্ছে, বাংলাদেশি ছাপ মেরে দেগে দেবে বলে!’’

Advertisement

‘‘আমাদের রাজাবাজারে কেউ কেউ বলছিল, এখানে কেউ বাংলাদেশ থেকে আসেনি, তো কিসের চিন্তা! আমি বলেছি, বারবার কাগজ দেখতে চাওয়ার অসম্মানের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াতে হবে।’’

‘‘টুম্পাদি, সাহিনাদি ‘এন আর সি’ নিয়ে আমার ডকু-ফিচারটা দেখতে এসো কিন্তু! নাম দিয়েছি ‘নিউ রাম চরিত’!’’

Advertisement

মঙ্গলবার, বর্ষবরণের রাতের অন্তরঙ্গ পরিসরের জমায়েতেও নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ক্ষোভ-প্রতিবাদের ছোঁয়াচ। তা থেকেই সঙ্কল্পের জন্ম। সমপ্রেমী দুই তরুণ রবি-বিনুর জুটি, ভিন্‌ ধর্মে বিয়ে করে ঘর থেকে উৎখাত মুসলিম তরুণী, যৌনপল্লিতে বড় হওয়া টুম্পা অধিকারী ও তাঁর মুসলিম অটোচালক স্বামী সামির মণ্ডল কিংবা অন্য রকম সাজপোশাকে স্বচ্ছন্দ রূপান্তরকামী নারী অচিন্ত্যের মতো কয়েক জন মিলে ঘরছাড়া বা ঘরহারাদের মঞ্চ গড়ার ডাক দিয়েছেন। দলের অন্যতম মুখ দিনাজপুরের বিনন্দন সরকারের কথায়, ‘‘সমকামী বলে আমরাও ঘর-বাড়ি থেকে উদ্বাস্তু। দেশের এক শ্রেণির মানুষকে ধর্মের কারণে আইন করে অ-নাগরিক বানানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবেই।’’ ভিন্‌ ধর্মে বিয়ে করে দেড় বছর ধরে কার্যত ঘরছাড়া ছিলেন হুগলির সাফিনা খাতুন। এত দিনে বাপের বাড়ির মন গলেছে। আস্তে আস্তে দুই বাড়িকেই বোঝাতে সফল নবদম্পতি। তাঁরাও সমব্যথী বৈষম্যমূলক আইনের ভুক্তভোগীদের প্রতি। দিল্লির শাহিনবাগের রাত থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকেল— দেশ জুড়েই বর্ষবরণের উদ্‌যাপন প্রতিবাদের রঙে রঙিন। মধ্য রাতে বন্ধুদের জমায়েতও কার্যত ঘরহারা বা ঘরছাড়াদের স্বর হয়ে উঠল।

গোলপার্কে এক বন্ধুর বাড়িতে আড্ডার দিন স্থির করার আগে এক মঞ্চে সংগঠিত হওয়ার কথা ভাবেননি ওঁরা। সমাজকর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘কাজের সূত্রে আমরা পরস্পরকে চিনি, ব্যক্তিগত লড়াইও জানি। এক সঙ্গে আড্ডা মারার দিন ঠিক করেই মনে হল, এখানেও তো বেশির ভাগই ঘরছাড়া কিংবা ঘর হারানোর ব্যথার শরিক।’’ বন্ধুদের এই দল এখন ভাবছে, ঘরছাড়া বা ঘরহারা হওয়ার মানেটুকুর বৃহত্তর ব্যঞ্জনা মেলে ধরেই নয়া নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদকে জোরালো করতে। তাঁদের বিশ্বাস, সেই সব টুকরো গল্প দিয়ে নানা ভাবে দেশের বহুত্বে ফাটল ধরানো বৈষম্যমূলক আইনের প্রতিবাদ করা সম্ভব।

রাজাবাজারে স্থানীয় মেয়েদের ক্ষমতায়ন বা অধিকারের লড়াই শেখানোর শরিক সমাজকর্মী সাহিনা জাভেদ, তাঁর বন্ধু মূল ধারার রাজনীতিতে যুক্ত সুমন পালও এ লড়াইয়ের শরিক। নানা ভাবে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদ তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন। মুসলিম ঘরের বৌ টুম্পা বলছিলেন, ‘‘কী ভাবে অনেক মুসলিম মেয়ে ইদানীং হিজাবগোছের পোশাক পরতে ভয় পাচ্ছেন। সাঁইথিয়ার কাছে উঁচপুর গ্রামের দেবগোপাল মণ্ডলের কলেজ জীবন ধ্বস্ত হয়েছিল তাঁর সমকামী পরিচয়ের কারণেই। সিউড়ির কলেজে বেশি দিন টিকতে পারেননি তিনি। অসমে ঘুরে ঘুরে এনআরসি বিভ্রাটের কাহিনি নিয়ে তথ্যচিত্র করতে গিয়েও বিভিন্ন ভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছেন তিনি। দেবগোপাল বললেন, ‘‘এন আর সি থেকেই ‘নিউ রাম চরিত’ নামটার ভাবনা।’’ আবহমান ভারত তো সাধারণের মধ্যে রামকে খোঁজে। রামকেও নির্বাসনে যেতে হয়েছিল বটে। বৈষম্যমূলক আইনের প্রতিবাদে সেই রামকে খোঁজার ডাকও দিচ্ছে ২০২০-র ভারতবর্ষ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement