বিদেশি বন্ধু শহরে এলে কলকাতা ঘুরে দেখাতে যে ক’টা জায়গায় নিয়ে যেতে চাইবেন কেউ, সেই লিস্টিতে থাকবেই কফি হাউস। অনেক দিন কলকাতাছাড়া যাঁরা, তাঁদের কাছেও তো ঘরে ফেরা মানে কফি হাউসেও ফেরা, নয় কি? এ তো স্রেফ একটা কফি খাওয়ার জায়গা নয়— বাহারি কতই তো কফি শপ এখন চার দিকে। বঙ্গজীবনের রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক যত টানাপড়েন আর উথালপাথাল, সব বুকে ধরে এগিয়ে চলেছে, এমন পরিসর আর ক’টিই বা!
১৫ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ইন্ডিয়ান কফি হাউস চেনেন সবাই। ক’জন জানেন, এখানে একদা ছিল কেশবচন্দ্র সেনের পিতামহ রামকমল সেনের বসতবাড়ি? ১৮৭৬ সালে এ বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা অ্যালবার্ট হল-এর, ১৮৮৩-তে ভারতীয় জাতীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন বসে সেখানে। কফি হাউসের এখনকার যে বাড়ি, তার নির্মাণ উনিশ শতকের শেষ দিকে। পুরনো বাড়িটিতে কে না এসেছেন, বক্তৃতা করেছেন— রবীন্দ্রনাথ, ভগিনী নিবেদিতা, গান্ধীজি, শরৎচন্দ্র বসু! ১৯৩০-এর দশকে অর্থনৈতিক মন্দার আবহে ভারতে কফির বাজার ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে, তা সামাল দিতে দেশ জুড়ে ৪৩টি ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউস’ খোলে কফি বোর্ড অব ইন্ডিয়া। তারই অন্যতম কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস: ১৯৪২ থেকে কর্তৃপক্ষ এই বাড়িটি ভাড়া নেন। পঞ্চাশের দশকে সরকার কফি হাউসগুলি বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বসেছিল, শ্রমজীবী-কর্মীদের ধর্মঘটের জেরে ক্রমে গড়ে ওঠে ওঁদের সমবায় ব্যবস্থা, তা-ই হয়ে ওঠে কফি হাউসের নিয়ন্ত্রক। সেই সমবায় কাঠামো আজও বহমান।
এই ইতিহাস ছাপিয়ে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস আজ গড়েছে নিজস্ব ইতিহাস। ছাত্র-শিক্ষক, কবি শিল্পী বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক কর্মী থেকে সাধারণ নাগরিক, সবাইকে দিয়েছে একাধারে ব্যক্তিগত ও সামূহিক এক ‘স্পেস’; রক্ষণ ও লালন করেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক স্মৃতি। এই স্মৃতি ও সত্তাই বইয়ে ধরে রেখেছেন ইয়াইল সিলিমান ও মালা মুখোপাধ্যায়। আড্ডা: দ্য কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস নামের ইংরেজি বইটি প্রকাশিত ২০২০ সালে, সম্প্রতি প্রকাশ পেল তার বাংলা সংস্করণটিও, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের আড্ডা! (প্রকা: সাধনা উদ্যোগ)। ইয়াইলের মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ মীনাক্ষী ঘোষের, যোগ্য সঙ্গত মালা মুখোপাধ্যায়ের আলোকচিত্র (ছবি)।
কফি হাউসের গৌরবময় যাত্রার ইতিহাস তো আছেই, বইয়ের মূল আকর্ষণ লেখক, প্রকাশক, থিয়েটার ও চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব, চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞান ও রাজনীতি-সহ সমাজের সব ক্ষেত্রের বিশিষ্টদের কফি হাউস নিয়ে স্মৃতি ও মন্তব্য। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণা বসু, যোগেন চৌধুরী, ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়, সব্যসাচী ভট্টাচার্য, হিরণ্ময় কার্লেকর, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেকের বয়ানে উঠে এসেছে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের অতীতকথা। তথ্য, গল্প আর ছবি মিলে এ যেন এক বহতা সময়ের নকশি কাঁথা। অভীক মিত্রের পুরনো কিছু ছবিও বড় প্রাপ্তি, সাদা-কালোতেও ধরা সোনালি বিকেল।
সরস প্রজ্ঞা
ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রন্থের ইতিহাস ও মুদ্রণের সংস্কৃতি-চর্চায় পথিকৃৎ তিনি। ইউরোপীয় ও ভারতীয় সাহিত্য ও অলঙ্কারশাস্ত্রে সুপণ্ডিত; লেখালিখি করেছেন নিয়মিত, সম্পাদনা করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু সঙ্কলন। যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবৎসল শিক্ষক স্বপন চক্রবর্তীর (ছবি) গভীর পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার পাশাপাশি রসবোধও ছিল অতুলন। পুরনো বই, দুষ্প্রাপ্য নথি ছিল তাঁর গবেষণার অন্যতম উপাদান; দক্ষ হাতে সামলেছেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর কিউরেটরের ভার, জাতীয় গ্রন্থাগারের সংরক্ষণ বিভাগের নবীকরণ ও ন্যাশনাল ডিজিটাল লাইব্রেরির নির্মাণ প্রচার ও প্রসারে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। ২০২১-এ প্রয়াত অধ্যাপকের সত্তরতম জন্মবার্ষিকীতে আগামী ২৯ জুলাই দুপুর ৩টেয় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ সভাঘরে প্রথম ‘স্বপন চক্রবর্তী স্মারক বক্তৃতা’, বক্তা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উদয় কুমার।
একলা গল্পগুলো
ব্যস্ত, বহির্মুখী এ জীবনে কেমন আছে আমাদের মন? কে রাখে তার খবর? বাইরের ‘সব পেয়েছি’র শেওলা সরিয়ে দেখলে পাওয়া যাবে একাকিত্বের টলটলে জল, কান্না। তার কারণ নানাবিধ: চার পাশের ক্ষয়, সমাজের থেকে ছিন্ন হওয়ার বোধ, কখনও নিজেকে ব্যর্থ ভাবা, কখনও বা রোগ শোক মহামারির প্রকোপ, আরও অনেক কিছু। ব্যক্তি ও সমাজের মনের স্বাস্থ্যের যত্নআত্তি বড় দরকার এই সময়ে, এই ভাবনাই এ বার শিল্পমাধ্যমে। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জ্ঞান মঞ্চে নীলাঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায় রিখিয়া বসু শুভেন্দু মুখোপাধ্যায় ও সহশিল্পীরা মণিপুরি নৃত্য ও মূকাভিনয়ের মিলিত আঙ্গিকে পরিবেশন করবেন ‘স্টোরিজ় অব সলিচিউড’। অন্য রকম ভাবনা।
মুখোমুখি
“একজন অভিনেতার কাছে এ রকম একটা চরিত্র পাওয়া আর তাকে সম্পূর্ণ করে তোলার জন্যে যে চেষ্টাটা... অতনুর মতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে সেটা যদি না করে উঠতে পারি,” অতনু ঘোষের শেষ পাতা ছবি প্রসঙ্গে বলছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। নিঃসঙ্গ নাগরিক চরিত্রেরা ঘুরেফিরে আসে অতনু ঘোষের ছবিতে, তাঁর ময়ূরাক্ষী রবিবার বিনিসুতো এই ট্রিলজির পরে শেষ পাতা ছবিতেও শহর কলকাতা বিপন্নতার বোধ সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতে চায় আত্মমর্যাদার লড়াইয়ে। এই নিয়েই দর্শকের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলবেন পরিচালক, আজ ২৭ জুলাই বিকেল ৫টায় নন্দন ৩-এ, দেখানো হবে ছবিটিও। সিনে সেন্ট্রাল, ক্যালকাটা-র আয়োজন এই ‘মিট দ্য ডিরেক্টর’ অনুষ্ঠান।
প্রাণ জুড়াবে
সময় থেমে থাকে না, থাকে স্মৃতি। সেই স্মৃতি আঁকড়ে বর্তমানের সঙ্গে সেতু বাঁধতে তেইশ বছর আগে তৈরি হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তনী সংগঠন ‘অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্ট’ (এএসিইউইডি)। দেশ-বিদেশে থাকা প্রাক্তনীদের একত্র করে কাঁটাকল ক্যাম্পাসের দিনগুলির স্মৃতি-রোমন্থন, পাশাপাশি বক্তৃতা, বই প্রকাশ, আলোচনা, বর্তমান ছাত্রদের বৃত্তিদান— নানা কর্মকাণ্ডে বছরভর ব্যস্ত ওঁরা। সেই সূত্র ধরেই আগামী কাল ২৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায় সল্ট লেকে রবীন্দ্র ওকাকুরা মঞ্চে অনুষ্ঠান ‘মোরা সুখের দুখের কথা কব’। গানে গত সাত দশকের ‘পড়ুয়া’রা; রয়েছে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবৃত্তি, প্রাক্তনীদের অভিনয়ে নাটক চক্রধারী।
তাহাদের কথা
লোরেঞ্জো মিলানি-কে কে চেনে? ১৯৫৪ সালে এই যাজক এসেছিলেন বারবিয়ানাতে: ফ্লোরেন্স থেকে দূরে, পাহাড় বনে ঢাকা, খেতখামারে কাজ করা কুড়ি ঘর লোকের এক বসতি। অচিরেই বুঝলেন এখানে কী দরকার, তৈরি হল নাইট-স্কুল: ফেলটুস, স্কুলছুট পড়ুয়াদের জন্য। রুটিন তৈরি হল, বড়রা পড়াতে লাগল ছোটদের, উঠে এল জীবনের অন্য সব প্রশ্নও। তারই ফসল স্কুলের আট ছাত্রের একটা প্রজেক্ট, একটা বই: লেটার টু আ টিচার বাই দ্য স্কুল অব বারবিয়ানা। মিলানি প্রয়াত ১৯৬৭-তে, বইটা অমর হয়ে গিয়েছে, ইটালি থেকে সারা বিশ্বে, বঙ্গেও। একেই নাটকে বেঁধেছেন তীর্থঙ্কর চন্দ, আপনাকে বলছি স্যর। আজ ২৭ জুলাই সন্ধে ৬টায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে অশোক মজুমদারের নির্দেশনায় ‘বেলঘরিয়া অভিমুখ’ তাদের নবম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন করবে এ নাটকে। অসিত মুখোপাধ্যায় স্মারক সম্মানে ভূষিত হবে গয়েশপুর সংলাপ।
বাঘের বই
সুন্দরবনের নদীতে লবণ বৃদ্ধি কি বাঘকে ক্রমশ উত্তরমুখী করে তুলছে? কী ভাবে ক্যামেরা ট্র্যাপে বাঘ গোনা হয়? ব্যাঘ্রপ্রকল্প কতটা কার্যকর হয়েছে পঞ্চাশ বছরে? পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীদের জীবনযাপনে বাঘের প্রভাব কতটা গভীর? এমনই নানা প্রসঙ্গকথা সুন্দরবনের বাঘ (সম্পা: জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী) বইয়ে। ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস, তারই আবহে আগামী কাল বিকেল সাড়ে ৫টায় অক্সফোর্ড বুক স্টোরে প্রকাশ পাবে বইটি, থাকবেন দেবল রায় কল্যাণ রুদ্র প্রমুখ। ভারত ও বাংলাদেশের বাঘ বিশেষজ্ঞ, জীববিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ, বনকর্মী আধিকারিক থেকে শুরু করে জঙ্গলের গাইড, সুন্দরবনের সাধারণ মানুষের বয়ান আছে বইতে, এমনকি চোরাশিকারিরও! আলোকচিত্রীদের ক্যামেরায় সুন্দরবনের বাঘের ছবি (সঙ্গের ছবিটি চন্দ্রশেখর কুণ্ডুর তোলা), বাঘ বিষয়ক বাংলা-ইংরেজি বইয়ের তালিকা, তথ্য-পরিসংখ্যানও।
পথিকৃৎ
বিশ শতকের ভারতীয় থিয়েটারের পুরোধা, ভারতে দৃশ্যশিল্প আন্দোলনে অগ্রণী প্রবক্তা। ইংল্যান্ডে ছাত্রাবস্থার পাঠ এগিয়ে দেয় সে কালের বম্বের নাট্যচর্চায় বাঁকবদলে; পরে দিল্লিতে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-র প্রধান হিসেবে এব্রাহিম আলকাজ়ি (ছবি, সৌজন্য: ইদ্রিস আহমেদ) পথ দেখিয়েছিলেন ‘মডার্নিস্ট’ ভারতীয় নাট্যচর্চাকে। এই মানুষটিরই জীবনকথা লিখেছেন তাঁর কন্যা আমাল আলানা, এব্রাহিম আলকাজ়ি: হোল্ডিং টাইম ক্যাপটিভ (ভিন্টেজ বুকস/পেঙ্গুইন)। বিশ শতকের সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিশারিদের সঙ্গ-অনুষঙ্গ এই বইয়ে: মকবুল ফিদা হুসেন, অ্যালেক পদমসি, নিসিম এজ়িকিয়েল, গিরিশ কারনাড, বিজয় মেহতা। এশিয়া সোসাইটি ইন্ডিয়া ও কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি-র উদ্যোগে গতকাল ২৬ জুলাই কেসিসি-তে বই ঘিরে হল আলোচনা, সুমন মুখোপাধ্যায় ছিলেন আমালের সঙ্গে কথালাপে।
কবি ও কবিতা
দেশভাগের কারণে আট বছর বয়সে এ শহরে আসেন গণেশ বসু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলার পাঠ, আইটিআই-তে সিভিল ড্রাফটসম্যানশিপ, বার্লিন থেকে জার্নালিজ়মেরও। বিচিত্র কর্মজীবন: গাড়ি কারখানায় কাজ, পত্রিকা সম্পাদনা; ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনা, পড়িয়েছেন পাঠভবন ও নবনালন্দা স্কুলেও। ছাত্রাবস্থাতেই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য: নেতৃত্বের আলোয় পথ দেখিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ অধ্যাপক সমিতি, লিটল ম্যাগাজ়িন ও কাব্য আন্দোলনকে। ১৯৬৪-তে লেখেন বনানীকে কবিতাগুচ্ছ, অন্য কাব্যগুলি: নিজের মুখোমুখি, রক্তের ভিতর রৌদ্র, বাঘের থাবার নীচে, নীরব সন্ত্রাস, অন্ন অশ্রু ভায়োলিন, ভাঙা বৈঠার গান, নরকরোটিতে প্রজাপতি, বলগা হরিণের শিং। ২০২৩-এ প্রয়াত কবির কবিতা সংগ্রহ দু’খণ্ডে প্রকাশিত আগেই, তৃতীয় খণ্ডের (দিয়া প্রকাশনী) প্রকাশ আজ ২৭ জুলাই বিকেল ৫টায়, যতীন দাস রোডে উইজ়ডম ট্রি কাফে-তে।