অসচেতন: ফের লাফিয়ে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। তবু লাগাম দেওয়া গেল না বর্ষশেষের ভিড়ে। অনেককেই দেখা গিয়েছে মাস্কহীন অবস্থায়। অনেক জায়গায় পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতন করা হলেও বিশেষ লাভ হয়নি। (১) আলিপুর চিড়িয়াখানা, (২) শ্রীভূমির পৌষ পার্বণ মেলা, (৩) ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও (৪) নিউ মার্কেটে। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী ও স্বাতী চক্রবর্তী
আরও একটি বছর ঘুরল। কিন্তু সংযত থেকে নিজেকে এবং অন্যকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ববোধ তৈরি হল না আমজনতার একাংশের মধ্যে। সারল না উৎসবের নামে বিধিভঙ্গের পুরনো রোগও। কাজে লাগল না পুলিশের কড়া নজরদারির দাওয়াই, মাস্কহীন মুখ দেখলেই ধরপাকড় চালানোর হুঁশিয়ারি!
বদলে পাড়ায় পাড়ায় সাউন্ড বক্স এবং রকমারি আলো লাগিয়ে রাস্তাতেই তৈরি হল ‘ডিস্কোথেক’। বয়স্কদের হৃৎকম্প ধরিয়ে সেখানে চটুল গানের সঙ্গে নাচ চলল অনেক রাত পর্যন্ত। দূষণের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের দেওয়া রায় উড়িয়ে বর্ষবরণের নামে ঠিক রাত ১২টায় বাজিও ফাটল বেশ কিছু জায়গায়। করোনা-সতর্কতার তোয়াক্কা না করেই দেদার খানাপিনা চলল শহরের ‘রুফটপ’গুলিতে। বহু ক্ষেত্রে সেগুলি পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল বলে অভিযোগ। কসবা অঞ্চলের এক বাসিন্দার মন্তব্য, ‘‘পার্ক স্ট্রিটে না হয় পুলিশ দিয়েছে। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় মোচ্ছব সামলাবে কে! সন্ধ্যা থেকেই গানের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আওয়াজ বাড়তে বাড়তে রাতে তারস্বরে গান বাজছে।’’
তবে সব কিছু ছাপিয়ে দিনভর যা সব চেয়ে বেশি আতঙ্ক বাড়িয়েছে, তা হল, বছরের শেষ দিন উদ্যাপনের নামে রাস্তায় নেমে আসা ভিড়।
পার্ক স্ট্রিট, বাবুঘাট, ময়দান, চিড়িয়াখানা, মিলেনিয়াম পার্ক, ভিক্টোরিয়া, প্রিন্সেপ ঘাটের মতো জায়গায় মাস্কহীন মুখের ভিড় দেখে বোঝার উপায় ছিল না, দূরত্ব-বিধি বলে আদৌ কিছু আছে! ৩১ ডিসেম্বর পার্ক স্ট্রিটে মাস্ক ছাড়া আসা যাবে না, রাজ্য প্রশাসনের এই নির্দেশকে অনেকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। কলকাতা পুলিশেরই হিসাব বলছে, বিধিভঙ্গের জন্য রাত আটটা পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ৩২ জনকে। মাস্ক না পরার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৪৬৪ জনের বিরুদ্ধে। তাতেও অবশ্য পরিস্থিতি বিন্দুমাত্র বদলায়নি। মূল শহরের মতোই উৎসব-পালনের ঠিকানা হয়ে উঠেছে বিধাননগরের নিক্কো পার্ক, নিউ টাউনের ইকো পার্কের মতো একাধিক জায়গা। সেখানেও এ দিন উৎসবমুখী জনতাকে সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেয়েছে পুলিশ।
তবে এ দিনই কলকাতা পুলিশের দায়িত্ব নিয়ে নতুন কমিশনার বিনীত গোয়েল বলেছেন, ‘‘একা পুলিশের পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মানুষেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। মাস্ক পরে তবেই বাইরে বেরোন।’’ কিন্তু আমজনতার তরফে সেই সহযোগিতার ছিটেফোঁটাও এ দিন দেখা যায়নি বলে অভিযোগ রাস্তায় থাকা পুলিশকর্মীদের বড় অংশের। মাইক নিয়ে চিড়িয়াখানায় সতর্কতামূলক প্রচার চালানোর সময়ে এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘অধিকাংশেরই তো মাস্ক নেই। বললে কেউ পকেট থেকে বার করে পরছেন, কেউ আবার আনতে ভুলে যাওয়ার দোহাই দিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ করে আক্রান্তের সংখ্যা দু’হাজার পেরিয়ে গিয়েছে জানা সত্ত্বেও যাঁদের হুঁশ হচ্ছে না, কোনও প্রচারেই তাঁদের হুঁশ হবে বলে মনে হয়? উল্টে ভিড়ে ঢুকে আমাদের বিপদ বাড়ছে।’’
চিড়িয়াখানায় বাঘের দর্শন সেরে বেরিয়ে আসার মুখে যাদবপুরের বাসিন্দা দেবাশিস ঘোষ বললেন, ‘‘বাঘ দেখলে এমনিই শরীর গরম হয়ে যায়। আর মাস্কের কথা মনে রাখা যায় না।’’ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের টিকিটের লাইনে দাঁড়ানো হাওড়ার সুনীতা ঘোষালের মন্তব্য, ‘‘সরকার যখন উৎসব করার সুযোগ করে দিচ্ছে, তখন করব না কেন? এখন শুধুই আনন্দ। করোনা নিয়ে ২ তারিখের পরে ভাবব।’’ মিলেনিয়াম পার্কের কাছে মাইকে প্রচার চালাতে চালাতে রীতিমতো হাঁপিয়ে ওঠা এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘খাতায়-কলমে মামলা করার সুযোগ থাকলেও আমাদের বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কার্যোদ্ধার করতে। বিকেলের পরে আরও ভিড় বাড়লে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখব।’’
বছরের শেষ সন্ধ্যা যত গড়াল, ওই পুলিশকর্মীর মন্তব্যই কার্যত সত্যি হতে দেখা গেল। বাড়তে থাকা ভিড়ের চাপে এক সময়ে দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হল পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাতে। সেখানে বড়দিনের ভিড়ের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হওয়া সমালোচনার মুখে এ দিন ওই রাস্তা গাড়ি চলাচলের জন্য খুলে দিয়েছিল পুলিশ। ফলে রাস্তার ভিড় গিয়ে পড়ে ফুটপাতে। সেখানেই কর্তব্যরত পুলিশকর্মীকে ডেকে এক তরুণী বললেন, ‘‘এর চেয়ে তো রাস্তার ভিড় ভাল ছিল। যেখানে যাচ্ছি সেখানে কতক্ষণে পৌঁছব বুঝতে পারছি না, পার্টি শুরু হয়ে গেলে কী হবে?’’ পুলিশকর্মীটি বললেন, ‘‘না বেরোলে হত না?’’ হেসে তরুণীর জবাব, ‘‘করোনার ভরা সময়ে গত ডিসেম্বরেই ছাড়িনি, এ বার তো পরিস্থিতি অনেক ভাল। আপাতত শুধু আনন্দ, আবার নতুন বছরে করোনা নিয়ে ভাবব।’’