সাজসজ্জা: বেডফোর্ড লেন থেকে অনুষ্ঠানের কাজে যাওয়ার আগে সান্তা হয়ে ওঠার প্রস্তুতি। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
স্যাঁতসেঁতে গলির এক দিকের দেওয়াল বরাবর পর পর দাঁড়িয়ে খুদের দল। এক-এক জনের নাম ধরে ডাক পড়ছে, তারা এগিয়ে যাচ্ছে লাল জোব্বা, চিরুনি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝবয়সি ব্যক্তির দিকে। তাদের গায়ে একের পর এক জোব্বা চাপিয়ে দিচ্ছেন তিনি। মুখোশ পরিয়ে সযত্নে মুখোশের দাড়িতে চিরুনি বোলাতে বোলাতে বলছেন, ‘‘সবার সঙ্গে নিজে থেকে হাত মেলাবে। ‘গুড ডে’ বলবে।’’
তা শুনে ঘাড় নেড়ে একের পর এক এগিয়েই চলছিল খুদের দল। হঠাৎ বেঁকে বসল তাদেরই এক জন। সে কিছুতেই সাজগোজের পোশাক পরবে না। মুখোশ দেখলেই ছুটে পালাচ্ছে। বলছে, ‘‘সান্তাক্লজ় সাজব না। চার্লি চ্যাপলিন হলে রাজি আছি।’’ অনেক বুঝিয়ে লজেন্স দিয়ে নিয়ে আসা হল তাকে। শেষে বলা হল, ‘‘ভাল খাওয়াদাওয়া আছে শেষে। টাকা কাজ শেষ হয়ে গেলেই পাবে!’’ সেই বালক যদিও এর পরে গাড়িতে উঠে শীতের পার্টিতে কাজ করতে যাওয়ার আগে বলে, ‘‘সান্তা সাজতেও ভালই লাগে। কত জনের সঙ্গে দেখা হয়!’’
৩ নম্বর বেডফোর্ড লেনের এই বাড়ি এলাকায় পরিচিত সেলিম জোকারওয়ালার বাড়ি নামে। কখনও এই বাড়ি থেকেই বার হন চ্যাপলিন, কখনও স্পাইডারম্যান। তবে শীতের এই সময়টায় সান্তাবুড়োর পাল্লা ভারী। এই বাড়ির প্রধান সেলিম আহমেদ ওরফে সেলিম জোকারওয়ালা বললেন, ‘‘শীতের মরসুমের পুরো সময়টাতেই সান্তার চাহিদা থাকে। তা ছাড়া সান্তা বা চ্যাপলিন যা-ই সাজুক, বাচ্চাগুলোর পার্টিতে যেতে পারলেই আনন্দ।’’ স্যাঁতসেঁতে গলির জীবনে এমন দিন কবে আসবে, এই বাচ্চাদের অনেকেই তার অপেক্ষা করে থাকে বলে সেলিমের দাবি। কিন্তু সান্তাবুড়োর মুখোশের আড়ালে যে দিনভর কাজ করে চলেছে এক খুদে, তা কি দেখতে চান কেউ? খুদের জন্মদিনের পার্টিতে আর এক খুদেই যে লোক হাসানোর কাজ করে চলেছে, তারই বা খোঁজ রাখেন ক’জন?
সেলিম বলেন, ‘‘এই বাচ্চারা কিন্তু লোক হাসিয়ে রোজগারের এই পথ ভালই বাসে। অনেক সময়ে অপমানিত হতে হয় ঠিকই। কিন্তু ওরা বোঝে, রোজকার এই ঘিঞ্জি গলির জীবনের মধ্যে এমন কাজের এক-একটা দিন খুব আনন্দের।’’
নিজের জীবনের গল্পে ফেরেন সেলিম। তাঁর ঠাকুর্দা হাবিব আহমেদ এবং বাবা রশিদের ছিল অনুষ্ঠান বাড়ি, দোকান সাজানোর ব্যবসা। ১৯৯২ সালে লিন্ডসে স্ট্রিটে তেমনই একটি দোকান সাজাতে গিয়েছিলেন সেলিম। বললেন, ‘‘দিনভর খেটে সাজানোর পরেও মালিক বলেন, সেলিম, এমন কিছু করুন, যাতে লোকের ভিড় লেগে যায়। সাধ্যমতো করার পরেও এ কথা শুনে রাগ হয়ে গিয়েছিল। মুখের উপরে বলে দিয়েছিলাম, তা হলে জোকার নিয়ে আসুন। লোক দেখতে ভিড় করবে। ওই কথাই যে সত্যি ধরে নেওয়া হবে, ভাবিনি।’’ এর পরে ওই মালিকের আবদারেই বাড়ি এসে দুই ছেলে সাব্বির এবং সাবিরকে জোকার সাজিয়ে নিয়ে যান সেলিম। পরে ভেবে দেখেন, এটাই তো হতে পারে নতুন ব্যবসার পথ! ধীরে ধীরে নোনাপুকুরের কাছে বেডফোর্ড লেনের সেলিম হয়ে ওঠেন সেলিম জোকারওয়ালা। এখন সেই কাজই করে চলেছেন তাঁর ছেলে ও মেয়ের ঘরের নাতি এবং পাড়ার খুদেরা।
এখন যারা সেলিমের কাছে সাজে, তাদের মধ্যে বছর পনেরোর জিশান আহমেদ আর দশ বছরের আব্দুল সামাদের দর সবচেয়ে বেশি। তাদের সাজিয়ে না পাঠালে কাজ ভাল হয়নি বলেই মনে করেন সেলিম। কিন্তু জিশান নিজে কী চায়? মধ্য কলকাতার এই অংশের একটি স্কুলের দশম শ্রেণির পড়ুয়া জিশান বলে, ‘‘ফুটবল খেলতে ভাল লাগে। কাজ থাকলে খেলতে যাওয়া যায় না। তবে সাজগোজ করে যেতে ভালই লাগে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কাজ করলে কিছু উপহারও পাওয়া যায়।’’ আব্দুল জানায়, সান্তা সাজার আগে ছোটখাটো উপহার প্যাকেটে ভরার সময়টা তার সবচেয়ে পছন্দের। তার কথায়, ‘‘অন্য বাচ্চাদের নিজের হাতে উপহার দিতে দারুণ লাগে। ওরা খুশি হয়ে হাত মেলায়। ভাবে, মুখোশের আড়ালে অনেক বড় বয়সের কেউ আছে। কিন্তু আমরাও যে ওদেরই বয়সি, অনেকেই তা বোঝে না।’’ হঠাৎই পরিণত শোনায় আব্দুলের গলা।
বড়রাও কি বোঝেন? সেলিম বলেন, ‘‘শহরের এক হোটেলে কাজ করতাম। সেখানে জোকার সাজিয়ে আমার হাত দিয়েই স্বাগত উপহার দেওয়া হত হোটেলে আসা বিশিষ্টদের। হিন্দি সিনেমার এক প্রথম সারির অভিনেতাকে সেই ভাবে উপহার দিতে যাওয়ায় তিনি এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে, ওই হোটেল জোকার নেওয়া বন্ধ করে দেয়। বাচ্চাদের নিজের অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়ে বলি, হাসি-হাসানোর এই পেশায় কাঁদার দিনও থাকে।’’