কলকাতা আর আড্ডার সম্পর্ক চিরকালীন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা থেকে ওপেন টি বায়োস্কোপের ফোয়ারা, সকলেরই বীরত্বের পরিচয় পাওয়া যেত পাড়ার রকের আড্ডায়। আড্ডা দিতে দিতে কখনও কেউ বলত আন্দামানে বীরত্বের গাথা, আবার কেউ শোনাত বোম্বাই থেকে টোকিও যাওয়ার গপ্পো।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়তনে বড় হয়েছে কলকাতা শহর। কিন্তু সংখ্যায় কমেছে কলকাতার বাড়ি। এ কালের কলকাতায় পাড়াগুলি বদলে গেল হাউসিং সোসাইটিতে। সকালে চায়ের দোকানে খবরের কাগজ নিয়ে উত্তেজিত চর্চা। আর সন্ধ্যাবেলা বাড়ির সামনে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বসার জায়গা, যাকে রক বলা হত, সেখানে পাড়ার মানুষদের সঙ্গে আড্ডা। চেনা এই ছবিই বদলে যাচ্ছে।
কলকাতার যে কয়েকটা পাড়া এখনও বেঁচে আছে সেগুলির রকে এখন আর কোনও টেনিদা কিংবা ফোয়ারাকে দেখা যায় না। সেগুলি এখন আশি উর্ধ্ব বয়স্কদের ইহকালের দিন শেষ হওয়ার জল্পনা করার জায়গা। বাগবাজারের একটি বাড়ির রকে বিকেলে বসে কয়েক জন বৃদ্ধ। তাঁদের এক জন বললেন, ‘‘আমরা মরে গেলে হয়তো আর কেউ থাকবে না এখানে বসার জন্য।’’ তাঁদের কথা থেকেই জানা যায়, এককালে এই রকে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য অনেক বকুনিই খেতে হত তাঁদের। পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের কথায়: ‘‘পাড়ার রকগুলিতে এখন আর আড্ডা হয় না, কোচিং সেন্টারে আসা বাচ্চাদের মায়েরা বসেন।’’
আবার কিছু পাড়ায় রকগুলো এখন ধুলোভর্তি। বাড়ি থাকলেও সেগুলো থাকে তালাবন্ধ। যেমন দেখতে পাওয়া গেল দক্ষিণ কলকাতার একটি পাড়ায়। বড় বড় বাড়িগুলির বেশির ভাগ সদস্যই থাকেন কলকাতার বাইরে। ফাঁকা পাড়ায় যে পাড়ার আড্ডা থাকবে না সেটা বলাই বাহুল্য।
কলকাতার মানুষ যে আর আড্ডা দেয় না, তেমনটা নয়। এ কালের কলকাতায় অতি-পরিচিত পাড়ার রকের আড্ডা বদলে গেছে ক্যাফেটরিয়ার আড্ডায়, ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে। শুধু রকে বসে নয়, বাড়িতে বসে আড্ডা দেওয়ার ধরনও বদলেছে। ফেসবুক নির্ভর আড্ডাটা কিন্তু পাড়ার আড্ডার মতো প্রাণবন্ত নয়, এমনটা জানাচ্ছেন অনেকেই। আর কলকাতার বড় বড় বাড়িগুলির জায়গা নিচ্ছে বহুতল ফ্ল্যাট। ফলে, বদলে যাচ্ছে কলকাতার পাড়ার সংস্কৃতি। পাড়ার সংস্কৃতিকে নতুন ভাবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে আবাসনগুলিতে। দুর্গাপুজো থেকে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা আয়োজন হচ্ছে, যাতে অন্তত বছরের কয়েকটা দিন একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়। কিন্তু, অনেকেই আবার মনে করছেন, যে আবাসন পাড়ার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সেগুলি মূলত অনেক পুরনো আবাসন। নতুন নতুন গড়ে উঠা আবাসনগুলিতে এই ধরনের অনুষ্ঠান তেমন দেখা যায় না।
আরও পড়ুন: চল রাস্তায় সাজি আড্ডায়
‘‘আড্ডা নিছক গপ্পো নয়, নিজেকে নতুন ভাবে জানা। নিজের জীবনের রসদ জোগান হয় আড্ডা থেকে,’’ এমনটাই জানাচ্ছেন পরিচালক অনীক দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘পুরনো কলকাতার মধ্যে যেমন অন্যের ব্যাপারে জানার আগ্রহ ছিল, তেমনই অন্যের প্রতি স্নেহও ছিল। এ কালের কলকাতা শুধু নিজেকেই চেনে। তাই আড্ডার ধরনও বদলে গেছে।’’ এই আড্ডার ধরন বদলের পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে বলেই মনে করছেন সমাজতত্ববিদ থেকে মনোবিদ সকলেই। যৌথ পরিবারের ভাঙন তার মধ্যে একটি। পরিবারের ভাঙন বহুতলের ‘নিজের মতো থাকা’র সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি, অনেকেই আবার মনে করছেন, এ কালের কলকাতা শুধুই বাঙালিদের নয়। কলকাতায় ক্রমশই বেড়ে চলেছে অবাঙালির সংখ্যা। তাঁরা মূলত থাকেন বহুতলে। বহু ভাষাভাষী হওয়ার ফলে কেউই তেমন একে-অপরের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার আনন্দ উপভোগ করে না বলেই মনে করছেন মনোবিদেরা। পাশাপাশি, কলকাতার মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব বাড়ছে বলেই জানাচ্ছেন মনোবিশেষজ্ঞেরা। মনোবিদ নীলাঞ্জনা স্যানাল বলেন, ‘‘মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতার সুরটা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ফলে সম্পর্কের মধ্যে স্বস্তিটা কমে যাচ্ছে।’’ অধ্যাপক প্রশান্ত রায়ের কথায়: ‘‘যে প্রজন্ম পাশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত সেই প্রজন্ম শেষ। পরের প্রজন্ম সেই ইচ্ছে হারিয়ে ফেলছে। আর পড়শির সমস্যাকে নিজের সমস্যা ভাবতে সক্ষমও হচ্ছেন না আজকের বাবা-মা। এখন মানুষ একান্ত আরামকেই বেশি উপভোগ করে।’’