আলোকিত: চন্দননগরের আলোকসজ্জা। নিজস্ব চিত্র
থিমের জোয়ারে কিছুটা হলেও কি কদর কমছে চন্দননগরের আলোর?
কয়েক বছর আগেও দুর্গাপুজোয় শহরের গলি থেকে রাজপথ সেজে উঠত একদা ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরের বাসিন্দা শিল্পীদের আলোর ভেল্কিতে। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা যে আজও সব পুজো কমিটি ধরে রেখেছেন, তা নয়। বরং দুর্গাপুজোর মতো, আলোকসজ্জাও হচ্ছে থিম নির্ভর। ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের সভাপতি কাজল সরকারের কথায়, ‘‘যাঁরা থিমের পুজো করছেন তাঁরা আর চন্দননগরকে ডাকছেন না। যে শিল্পী মণ্ডপ বানাচ্ছেন তিনিই ঠিক করে দিচ্ছেন আলোকসজ্জা কেমন হবে।’’ শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণের পুজোর উদ্যোক্তাদের অধিকাংশের দাবি, সবই এখন প্যাকেজের মধ্যে চলে গিয়েছে। আর দর্শকদেরও থিমের প্রতি আগ্রহ বেশি। তাই আলাদা করে আলোকসজ্জা দেখিয়ে দর্শক টানার প্রয়োজন হয় না।
তবুও চন্দননগরের আলোর নিজস্ব ঐতিহ্য বা ঘরানা রয়েছে বলেই মনে করেন সিংহী পার্ক পুজো কমিটির সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। আবার একডালিয়া এভারগ্রিনের কর্মকর্তা তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘চন্দননগরের আলো ব্যবহারকে, একটা পরম্পরা বলা চলে।’’ তিনি জানান, প্রতি বছরই জগদ্ধাত্রী পুজোয় নতুন ভাবনার আলোকসজ্জা প্রকাশ্যে আনতেন চন্দননগরের শিল্পীরা। সেটা দেখেই পরের বছরের দুর্গাপুজোর জন্য বায়না করতেন শহরের পুজো উদ্যোক্তারা। কপিল দেবের উইকেট নেওয়া থেকে শুরু করে ট্রেন দুর্ঘটনা—সমকালীন ঘটনা সব সময়েই চন্দননগরের আলোর খেলায় ফুটে উঠত বলেই জানান সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের সভাপতি প্রদীপ ঘোষ।
চলতি হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলোর কারিকুরি প্রায় বছর পনেরো আগেই শুরু করেছে চন্দননগর। সেই সময়ে এডস নিয়ে বুলাদির প্রচারও উঠে এসেছিল আলোকসজ্জায়। চন্দননগর লাইট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শ্রীধর দাসের কথায়, ‘‘কম্পিউটারের সাহায্যে ত্রিমাত্রিক পদ্ধতিতে তৈরি আলোর বুলাদি বসিয়েছিলাম শহরের পাঁচটি জায়গায়।’’ এ বছরেও দুর্গাপুজোয় যেমন চন্দননগরের চাইনিজ এলইডি আলোর কারিকুরিতে শহর থেকে শহরতলি দেখেছে মহাকাশ অভিযান, সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ, জল সংরক্ষণ এবং দিদিকে বলো।
তবে দুর্গা নয়, ১৯৫৮ সালে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, পাইকপাড়া, ফাটাকেষ্টর কালীপুজোয় প্রথম চন্দননগরের আলোকসজ্জা হয়েছিল বলে জানান শ্রীধরবাবু। পরের বছরে তিনি দুর্গাপুজোয় কলেজ স্কোয়ারে আলোর ছুটে চলার কারিকুরি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ১৯৬০ থেকে চন্দননগরের আলোই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়ায় শহরে। তখন অবশ্য বেতের কাঠামোয় রঙিন কাগজে মোড়া বাল্ব সাজানো হত। এর পরে টুনি বাল্বের সঙ্গে রোলার মোটরের যুগলবন্দিতে খেলা থেকে রাজনীতি, বাচ্চাদের গল্প ফুটতে শুরু করল আলোকসজ্জায়।
থিমের বাজারে নিজেদের শিল্প টিকিয়ে রাখতে নতুন ধরনের ভাবনা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে বলেই জানান শিল্পীরা। সিংহী পার্ক, নেতাজি কলোনি লো ল্যান্ডের আলোক শিল্পী পিন্টু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘থিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কত কম খরচে নতুন ধরনের আলোর খেলা কমিটি দেখাতে পারে, তা নিয়েও ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে।’’ আবার আলোকসজ্জার জন্য বাঁশের কাঠামো না বেঁধে সরু লোহার পাত দিয়ে মডেল বানিয়ে তাতে পিক্সেল এলইডি দিয়ে সাজানো হচ্ছে বলেও জানান এ বছর শ্রীভূমি, বেলডাঙা, সুরুচি সঙ্ঘের বিসর্জনে আলোর দায়িত্বে থাকা শিল্পী বাবু পাল।
প্রায় ১৪ বছর আগে পুজোয় বিদ্যুৎ ব্যবহারে নির্দিষ্ট দাম বেঁধে দিয়েছিল সিইএসসি। তাতে আলোকসজ্জায় এক লক্ষ টাকা খরচ হলে বিদ্যুতের বিল মেটাতে হচ্ছিল তার থেকেও
অনেক বেশি। তাই আলোর বদলে থিমের মণ্ডপের দিকে ঝোঁকেন উদ্যোক্তারা। অগত্যা বিদ্যুতের বিল কমাতে প্রথমে এলইডি প্রচলন করেন চন্দননগরের ডুপ্লেক্সপল্লির বাসিন্দা শিল্পী অসীম দে।
তবে তুরুপের তাস জগদ্ধাত্রী পুজোতেই বার করেন চন্দননগরের শিল্পীরা। কলেজ স্কোয়ারের আলোকসজ্জায় থাকা শিল্পী কাশীনাথ দাসের কথায়, ‘‘জগদ্ধাত্রী পুজো হল আলোর বিজ্ঞাপনের মাধ্যম। সেই সময়ই আমাদের কাজ দেখে পরের বছরের জন্য বুকিং হয়। তবে সারা বছরই ভাবতে হয় বারোয়ারি পুজোকে কী ভাবে স্বাচ্ছ্যন্দ দেব।
তারা না থাকলে যে আমাদের পেটে টান পড়বে।’’