বিরোধীদের দাবি, এই কেসের ভয় দেখিয়েই তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের নির্যাতন করা হচ্ছে। ফাইল ছবি
কিছু হলেই ‘গাঁজা কেস’! কখনও হুমকি দেওয়ার অস্ত্র, কখনও সত্যিই ‘কড়া পদক্ষেপের’ নিদর্শন। গত কয়েক বছরে মাঝেমধ্যেই রাজ্য-রাজনীতির অন্যতম চর্চার বিষয় ‘গাঁজা কেস’। বিরোধীদের দাবি, এই কেসের ভয় দেখিয়েই তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের নির্যাতন করা হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়েছে শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার এই সংক্রান্ত হুমকি ভিডিয়োও। এ বার বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারককে পাঠানো হুমকি চিঠির জেরে ফের চর্চায় গাঁজা কেস!
প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের বড় অংশেরই দাবি, এ এমন মামলা, যাতে যাঁকে খুশি ফাঁসিয়ে দেওয়া সম্ভব। জায়গা মতো প্রয়োগ করলে কার্যত শেষ করে দেওয়া যায় নিশানায় থাকা ব্যক্তির ভবিষ্যৎ। তবে আইনজীবীদের বড় অংশই জানাচ্ছেন, এই আইনে কড়াকড়ি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ভুল প্রয়োগ করে নিজেরই ফেঁসে যাওয়ার ঝুঁকি। আইনের কড়াকড়ি সত্ত্বেও ফাঁসিয়ে দেওয়া নির্দোষ ব্যক্তির হয়ে লড়াইয়ের সুযোগও রয়েছে।
আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, গাঁজা-সহ কাউকে গ্রেফতার করা হলে ১৯৮৫ সালের ‘নার্কোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস (এনডিপিএস) অ্যাক্টে’ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একেই চলতি ভাষায় গাঁজা কেস বলে। এই আইনে অভিযুক্তকে গাঁজা ব্যবহারকারী এবং গাঁজাব্যবসায়ী— এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সাধারণত কারও কাছ থেকে ২০ কিলোগ্রামের কম গাঁজা উদ্ধার হলে তাঁকে মাদক কারবারি হিসেবে ধরা হয় না।
এই আইনে এক কিলোগ্রাম বা তার কম পরিমাণ গাঁজা কারও কাছ থেকে উদ্ধার হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ছ’মাসের হাজতবাস এবং ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। কারও কাছ থেকে ১-২০ কিলোগ্রামের মধ্যে গাঁজা পাওয়া গেলে হাজতবাস হতে পারে ১০ বছর এবং জরিমানা এক লক্ষ টাকা। কিন্তু ২০ কিলোগ্রামের বেশি গাঁজা উদ্ধার হলে ১০-২০ বছরের হাজতবাস এবং ১-২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এটা বিশেষ আইন, তাই এতে জামিন পাওয়ার সুযোগ কম। সেটাই কাজে লাগিয়ে অনেক সময়ে স্বার্থসিদ্ধি হয়। জয়ন্তনারায়ণ বলেন, ‘‘এক বার এক জন পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে এক মহিলাকে ধর্ষণ করার মামলার তোড়জোড় চলছে। হঠাৎ মহিলা বেপাত্তা। দেখা গেল, তাঁর খুব কাছের এক জনকে গাঁজা কেসে ধরা হয়েছে। হুমকির অডিয়ো রেকর্ডিং ছিল। যেখানে পুলিশকে ওই মহিলার উদ্দেশে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘ওর নামে ২০ কেজি দিয়ে হাজতে ভরেছি, এর পর তোকে আরও ২০ কেজি দিয়ে জেলে ভরব।’ বহু ক্ষেত্রে বিচারক এ সব বুঝে ছেড়ে দেন।’’ তাঁর মতে, এই ধরনের মিথ্যা মামলার ঘটনায় সরকারি আইনজীবীদের বেশি দায়িত্ববোধ দেখানো উচিত।
আইনজীবী সেলিম রহমান যদিও বললেন, ‘‘সত্যিটা বার করতে চাইলে এই গাঁজা কেসের বিরুদ্ধেও লড়াই সম্ভব। এ ক্ষেত্রে কোথা থেকে গাঁজা উদ্ধার হয়েছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই কয়েকটা দিক চেপে ধরলেই সত্যিটা বেরিয়ে আসে। যেমন কারও কাছে গাঁজা রয়েছে, এটা তদন্তকারী সংস্থা জানল কী ভাবে সেটা চেপে ধরতে হয়। খোঁজ পেয়ে কী কী পদক্ষেপ করা হল, সেটাও আর একটি দিক।’’ ওই আইনজীবী জানাচ্ছেন, তদন্তকারী সংস্থার যে অফিসার গাঁজা উদ্ধার করলেন, তাঁর রেকর্ড ভাল হওয়া দরকার। অভিযানে যাওয়ার আগে অন্তত স্থানীয় দু’জনকে দিয়ে ওই তদন্তকারীর নিজেকে তল্লাশি করানোর নিয়ম। পরে আদালতে ওই দু’জনকে জানাতে হয়, তদন্তকারীর সঙ্গে আগে থেকে মাদক ছিল না। সেলিম বলেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাড়াহুড়োয় তদন্তকারী অফিসার নিজেকে তল্লাশি করাননি। নয়তো নিজের লোককে দিয়ে তল্লাশি করার তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে।’’
আইনি লড়াই লড়ে বেরিয়ে আসা গিরিশ পার্কের এমনই এক যুবক বললেন, ‘‘এক সময়ে লড়াই জিতেছি ঠিকই, কিন্তু তত দিনে সামাজিক সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকেনি। গাঁজা কেসই সব শেষ করে দিয়েছে।’’