অসহায়: বাড়িতে মঞ্জু সর্দার। নিজস্ব চিত্র
হাসপাতালের ‘রেফার’ রোগের প্রতিকারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘কোনও রোগীকে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতাল থেকে ফেরানো যাবে না।’ তবু ক্যানসার আক্রান্ত রোগীকেও সেই রেফারের চক্রব্যূহে পড়তে হচ্ছে, তার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে দু’দফায় ফিরে যাওয়া বছর তেত্রিশের মঞ্জু সর্দার। হাসপাতালের রেডিয়োথেরাপি বিভাগের প্রধানের যুক্তি, ‘‘শয্যা নেই। জুনিয়র চিকিৎসকেরা সম্ভবত ঝুঁকি নিতে চাননি।’’
রোগীর ননদ কল্পনা নায়ারের প্রশ্ন, ‘‘বৌদির ক্যানসার দ্রুত ছড়াচ্ছে বুঝতে পারছি। তাই বলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ থাকতেও এ ভাবে বাড়িতে থাকতে হবে?’’ বিধাননগর পুর এলাকার সুকান্তনগরের বাসিন্দা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মঞ্জুর কপালে হাত রেখে তাঁর স্বামী ঊষা সর্দারের আক্ষেপ, ‘‘খুব কষ্ট পাচ্ছে। একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না!’’
বছর তিনেক আগে দুই সন্তানের মা মঞ্জুর স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে। সেই থেকে এনআরএসে তাঁর চিকিৎসা চলছে। ইউএসজি রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্যানসার যকৃতেও ছড়িয়েছে এবং তা অন্তিম পর্যায়ে। সম্প্রতি ফ্লুইড জমে পেট ফুলে যায় মঞ্জুর। সোমবার এনআরএসে রেডিয়োথেরাপির বহির্বিভাগে নিয়ে যান তাঁর পরিজনেরা। টিকিটে স্থানীয় হাসপাতালে ফ্লুইড বার করার চিকিৎসা (প্যারাসেন্টেসিস) করতে লিখে দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে, সেই টিকিটে চিকিৎসক হিসেবে বিভাগীয় প্রধান শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডলের নাম রয়েছে। কল্পনার কথায়, ‘‘হিমোগ্লোবিন কম থাকায় ফ্লুইড বার করার পাশাপাশি বৌদিকে দু’ইউনিট রক্তও দিতে হত। কিছু না শুনেই মহকুমা হাসপাতালে পাঠানো হয়।’’
ঊষা জানান, এনআরএস থেকে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে রোগীকে পাঠানো হয়েছে জেনে অবাক সেখানকার চিকিৎসকেরা। সেখানকার জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ‘অ্যাডভাইস নোটে’ জানান, সার্জারির কলবুক অনুযায়ী সেখানে ফ্লুইড বার করার সুযোগ নেই। তাই লিখে দেন, ‘রেফার ব্যাক টু এনআরএস’!
স্ত্রীকে নিয়ে সোমবার বিকেল ৪টে নাগাদ ফের এনআরএসে যান ঊষা। রেডিয়োথেরাপির বহির্বিভাগ তখন বন্ধ। জরুরি বিভাগ থেকে ফ্লুইড বার করার নোট লিখে জেনারেল সার্জারিতে রোগীকে পাঠানো হয়। ঊষার অভিযোগ, ‘‘বিভাগীয় শল্য চিকিৎসকেরা জানান, পেট থেকে ফ্লুইড বার করলে আরও জমবে। সংক্রমণের আশঙ্কাও রয়েছে। বাকি সিদ্ধান্ত পরিজনদের উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়।’’ ঊষা জানান, রোজগার নষ্ট করে রোজ হাসপাতালে চক্কর কাটা সম্ভব নয়। তাই স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি চলে যান তিনি। আপাতত বাড়িতেই রয়েছেন মঞ্জু।
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় জানান, শয্যার অভাবে রেফারের চল রয়েছে। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের জন্য শয্যা রাখতে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘রেডিয়োথেরাপি বিভাগে ভর্তি করে শেষ পর্যায়ের ক্যানসার আক্রান্তের চিকিৎসা করা জরুরি। তবে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে সুচ ফুটিয়ে জল বার করার পরিকাঠামো নেই, এটাও বিস্ময়কর।’’
রেডিয়োথেরাপির বিভাগীয় প্রধান শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল জানান, তাঁর বিভাগে মহিলাদের শয্যা নেই। স্ত্রীরোগ বিভাগের ছ’টি শয্যা নিয়ে টানাটানির সংসার। মহিলাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওয়ার্ড তৈরির কাজ চলছে। তাঁর কথায়, ‘‘শয্যার অভাবে ওই পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। মহকুমা হাসপাতাল নোট না দিয়ে সেটা করলেই পারত।’’ দ্বিতীয় বার ফিরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, জুনিয়র চিকিৎসকেরা সম্ভবত ঝুঁকি নিতে চাননি। বিভাগীয় প্রধানের আশ্বাস, ‘‘অন্যেরা ফেরালে রোগীদের ফের রেডিয়োথেরাপিতে আসতে বলা থাকে। ওই রোগী এলেও তাঁর চিকিৎসা হবে।’’ তবে সেটা প্রথমেই কেন হল না? নিরুত্তর বিভাগীয় প্রধান।