নিজের স্বপ্নের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের একটি নাম দিতে ও ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের আমন্ত্রণ নিয়ে ১৯৩৯-এর জানুয়ারিতে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯ অগস্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন হল, শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও এলেন রবীন্দ্রনাথ। শিশিরকুমার বসু স্মৃতিকথায় লিখেছেন, সপরিবারে তাঁরা ভিত্তিস্থাপনের মণ্ডপে হাজির হলেন। খুব ইচ্ছে, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি তুলে রাখেন। কিন্তু মণ্ডপের ভিতরে আলো খুব কম, আর তাঁর ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ নেই। দেখলেন, আনন্দবাজার পত্রিকা-র চিত্রগ্রাহক প্রতিনিধি, বন্ধু বীরেন সিংহ সেখানে উপস্থিত। হাতে ফ্ল্যাশ-সহ ক্যামেরা। শিশিরবাবু বন্ধুকে বললেন, ফ্ল্যাশ দেওয়ার ঠিক আগে ইশারা করলেই তিনিও নিজের ক্যামেরার শাটার খুলে দেবেন। সেই মতোই মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন এক ফ্রেমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্র বসু ছাড়াও বেশ কিছু ভাল ছবি তুলেছিলেন শিশিরবাবু। কে জানত, সেই তারিখটিই পরে ঘটনাচক্রে স্বীকৃতি পাবে বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস হিসেবে! তাঁর ক্যামেরায় ধরা আছে পিতৃশ্রাদ্ধের পর মুণ্ডিতমস্তক সুভাষচন্দ্রের সন্ন্যাসীসুলভ চেহারা, বা ১৯৪০ সালের রামগড় সম্মেলনে পতাকা উত্তোলনকারী আপসহীন দেশনেতার দৃপ্ত ভঙ্গিও।
শিশিরকুমার বসু বা বীরেন্দ্রনাথ সিংহের মতো মানুষের পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেও উত্তাল চল্লিশের দশকে ফোটো-ডকুমেন্টেশনে এগিয়ে এসেছিলেন কিছু মানুষ। যেমন কলকাতার রাজপথে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আগুনে ছবি ক্যামেরায় ধরেছিলেন সুনীল জানা। বামপন্থী নেতা পি সি জোশির উৎসাহে ফোটোগ্রাফি নিয়ে নিজের শখের অভিমুখ ঘুরিয়ে তিনি মন দিলেন সে সময় বাংলার বুকে ছড়িয়ে পড়া ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের প্রতিবেদন তৈরিতে। বাকি দুনিয়ার নজর কাড়ল পি সি জোশির ‘হু লিভস ইফ বেঙ্গল ডাইজ়’-এর মতো লেখার সঙ্গে ছাপা সুনীলের ছবি। পরবর্তী কালে টাইম ম্যাগাজিনের বিখ্যাত আলোকচিত্রী মার্গারেট বার্ক-হোয়াইট’এর সঙ্গে কাজ করার মতো সম্মান পেলেও দ্রোহকালের এই কড়চাকার আজ বিস্মৃতপ্রায়।
লাইফ ম্যাগাজিনের খ্যাত চিত্রপ্রতিনিধি মার্গারেট বার্ক-হোয়াইট ভারতে আসেন মূলত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিত্বকে ছবির ভাষায় তুলে ধরতে। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে ছেচল্লিশের দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতার নানা ঘটনা তাঁর ক্যামেরায় বন্দি হল। উত্তাল চল্লিশের প্রথম দিকে কলকাতার জনজীবনের নানা খণ্ডচিত্র ধরা পড়েছিল বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান ফৌজের সঙ্গে শহরে আসা সামরিক ফোটোগ্রাফার ক্লাইড ওয়াডেল-এর লেন্সে। এই বিদেশি শিল্পীদের পাশে তৎকালীন লাটভবনের সরকারি চিত্রগ্রাহক হিসাবে পার্ক স্ট্রিটের ‘বম্বে ফোটো স্টুডিয়ো’র কর্ণধার জয়ন্ত পটেলের তোলা ছবি হদিস দেয় স্বাধীনতার আগে-পরে রাজভবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের।
স্বাধীনতার মাসেই, ১৯ অগস্ট উদ্যাপিত হয় বিশ্ব ফোটোগ্রাফি দিবস। সেই আবহে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অনালোচিত কুশীলবদের স্মরণ করার প্রয়োজন আছে। ছবিতে ১৯৪৫-এর কলকাতায় কেরোসিনের লাইন, ক্লাইড ওয়াডেল-এর ক্যামেরায়, উইকিমিডিয়া কমনস।
প্রয়াণদিনে
এ বছরই নববর্ষের সন্ধ্যায় নন্দনে হরিসাধন দাশগুপ্তের (ছবি) জন্মশতবর্ষ স্মরণ-অনুষ্ঠানে শোনা গিয়েছিল আনন্দসংবাদ, এক বছর জু়ড়ে নানা অনুষ্ঠান ও উদ্যোগ করা হবে, যথাসাধ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা হবে হরিসাধন-পরিচালিত ছবিগুলির। ওঁর কাহিনিচিত্র কমললতা যত না দর্শকমহলে পরিচিত, একই অঙ্গে এত রূপ ছবিটি তত নয়, মাধবী মুখোপাধ্যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বসন্ত চৌধুরী ছায়া দেবী দীনেন গুপ্ত আলি আকবর খান প্রমুখ তারকা কলাকুশলী জড়িয়ে থাকার পরেও। এপ্রিলের অনুষ্ঠানেই স্মৃতিচারণে মাধবী মুখোপাধ্যায়, একই অঙ্গে-র ‘হাসি’ বলেছিলেন এই ছবি গড়ে ওঠার কাহিনি, সেই সূত্রে হরিসাধনের শিল্পরসিক নান্দনিক মনটির কথাও। ১৯ অগস্ট হরিসাধনের প্রয়াণদিন, কলকাতা সেই সন্ধ্যায় দেখবে একই অঙ্গে এত রূপ, রোটারি সদন প্রেক্ষাগৃহে সন্ধ্যা ৬টায়। ছবি নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় গৌতম ঘোষ অশোক বিশ্বনাথন ও ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী।
পরম্পরা
প্রকৃত শিক্ষকেরা রেখে যান পরম্পরা, তাঁদের সবচেয়ে বড় কীর্তি। মণিপুরি নৃত্যগুরু বিপিন সিংহ প্রয়াত চব্বিশ বছরেরও বেশি, তাঁর শেখানো পথে এই নৃত্য আঙ্গিকের প্রদীপটি জ্বালিয়ে রেখেছেন ওঁর বহু ছাত্রছাত্রী, শিখিয়ে চলেছেন পরবর্তী প্রজন্মকে। সঙ্গীত নাটক অকাদেমি সম্মাননায় ভূষিত নৃত্যশিল্পী শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর প্রতিষ্ঠান শ্রুতি পারফর্মিং ট্রুপ আগামী ২৩ অগস্ট সন্ধ্যায় আইসিসিআর-এর সত্যজিৎ রায় প্রেক্ষাগৃহে শ্রদ্ধা জানাবে বিপিন সিংহকে, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ক্লাসিক্যাল মণিপুরি নৃত্য উৎসবে; সঙ্গী আইসিসিআর। থাকবেন পি বিলাস সিংহ, পদ্মশ্রী দর্শনা জাভেরি, গুরু কলাবতী দেবী, মীনাক্ষী মিশ্র, তপতী চৌধুরী, প্রীতি পটেল প্রমুখ।
পর্দায় আর্জেন্টিনা
রোমা নামের ছবিতে বোহেমিয়ান লেখক ফিরে যান তাঁর যৌবনের বুয়েনোস আইরেসে। কাসাস দে ফুয়েগো-র উপজীব্য ত্রিশ দশকের আর্জেন্টিনায় সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে এক ডাক্তারের ভূমিকা। এসপেরান্দো লা কারোজ়া ছবিতে অশীতিপর মায়ের দায়িত্ব কে নেবে, সে প্রশ্ন একরাশ অস্বস্তি নিয়ে এসে দাঁড়ায় সন্তানদের সামনে, এলসা ই ফ্রেড ছবিতে জীবনের উপান্তে দুই প্রবীণ ফের পড়েন প্রেমের ফাঁদে। চারটি ভিন্ন স্বাদের ছবি, ‘আর্জেন্টিনার সিনেমা’ শীর্ষক উৎসবে। ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস-এর উদ্যোগ, সঙ্গী দিল্লির আর্জেন্টিনা দূতাবাস। ১৯-২০ অগস্ট নন্দন ৩-এ, দুপুর সাড়ে ৩টে থেকে। উদ্বোধনে ভারতে আর্জেন্টিনা দূতাবাসের কনসুলার প্রধান মার্সেলো বফি।
রূপান্তরের রূপ
১৯৩৩-এ লেখা নাটক ১৯৩৮-এ হয়ে উঠল নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা। তবে রবীন্দ্রনাথেরও আগে, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে মূল কাহিনি জাতকের শার্দূলকর্ণাবদান অবলম্বনে মালয়ালি কবি কুমারন আসান লিখেছিলেন কবিতা ‘চণ্ডালভিক্ষুকী’, কেরলের নিম্নবর্গীয় মানুষ সেখানে খুঁজে পান প্রতিবাদের ভাষা। ১৯০২-এর বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত, সতীশচন্দ্র রায়ের ‘চণ্ডালী’-র প্রেরণাও একই সূত্র। একাধিক ভাষায় শার্দূলকর্ণাবদান-এর রূপান্তরের ইতিহাস নিয়ে গানের দল ‘পুনশ্চ’-র নিবেদন ‘ক্ষুধার্ত প্রেম’। নাটকের গদ্য-সংলাপ ও নৃত্যনাট্যের গান-সংলাপ নিয়ে গড়া এই নিবেদন, ভিত্তি শঙ্খ ঘোষের ‘তিন চণ্ডালী’ প্রবন্ধ। সূচনাপর্বে রবীন্দ্র-জীবনের শেষ পর্বে লেখা বর্ষার গান গাইবেন ইন্দিরা, বৈতালিক ও রবিছন্দম-এর শিল্পীরা। রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে আজ ১৭ অগস্ট, সন্ধ্যা ৬টায়।
দেশভাগ নিয়ে
দেশভাগের পরিণাম— ইতিহাস সমাজ ও জনজীবনে তার প্রভাব নিয়ে চর্চা আজও অব্যাহত। প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে তা নিয়ে কাজ করে চলেছেন ইতিহাসবিদ লেখক-চিন্তকেরা, তাঁদের ভাবনা সংহত রূপ পাচ্ছে নানা বইয়ের পাতায়। সেই তালিকাতেই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন দ্য লং হিস্ট্রি অব পার্টিশন ইন বেঙ্গল (প্রকা: রাটলেজ), জুলাইয়ে প্রকাশ পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়া সংস্করণ। প্রশাসন থেকে শুরু করে শরণার্থী পুনর্বাসনের সরকারি নীতি কেমন রূপ পেল দেশভাগের কারণে, কোন ছায়া ফেলল সাহিত্যে চলচ্চিত্রে, উদ্বাস্তু ক্যাম্প ও কলোনিগুলিতে কেমন ছিল জীবন, এমনই নানা বিষয় এই বইয়ে। আজ সন্ধ্যা ৬টায় এ বই নিয়েই আলিপুর মিউজ়িয়মে কথা বলবেন দুই ইতিহাসবিদ অধ্যাপক, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুগত বসু।
পুজোর ট্যাক্সি
শ্রাবণবিকেলে শহরে নতুন ট্যাক্সি। যেন বাগান-গাড়ি: মাথার উপর কামিনী-ছায়া, দু’চারটে ফুল বৃষ্টির ফোঁটার মতো ফুটে আছে; আর সারা শরীরে আঁকা কলকাতার মূর্তি, ঝলমলে রঙে। ভিক্টোরিয়ার অলিন্দ থেকে শুরু করে শ্যামবাজারের নেতাজি, বাঘা যতীন থেকে ক্ষুদিরাম। একাকী আউট্রামের ছুটন্ত ঘোড়া, চাকার উপর আস্ফালনরত অশ্বশক্তির প্রতীক। কর্নওয়ালিসের পার্শ্বমূর্তি, ফুলের স্তবক হাতে শ্রদ্ধায় ক্ষুদিরামের মূর্তির পাদদেশে। গাড়ির মালিক ধনঞ্জয় চক্রবর্তী, শহর চেনে ‘বাপী গ্রিন ট্যাক্সি’ নামে, জীবনব্রত: সবুজ সৃষ্টি। কলকাতার পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘের এ বছরের পুজো-ভাবনা ‘কলকাতার মূর্তিকথা’, তারই দূত এই গাড়ি, ঘুরবে শহরে। মানুষ চড়তেও পারবেন টালা থেকে টালিগঞ্জ যেতে। শিল্পী সায়ন মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সঙ্গীদের এই কাজ— সবুজের বার্তা দিতে তো বটেই, দেশবরেণ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূর্তির প্রতি প্রণত হতেও।
নতুন বেশে
স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ভারতের বয়নশিল্পও। সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে চরকার প্রতিষ্ঠায় তারই স্বীকৃতি। নীল চাষীদের দুর্দশা, ভারতে বিলিতি কাপড় প্রচলনে তাঞ্জাভুরের রেশম বস্ত্রশিল্পীদের দুর্গতি পোক্ত করেছে ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াইকে। ভারতীয় চিত্রশিল্পীরা ছবি এঁকেছেন এই নিয়ে, দিল্লি আর্ট গ্যালারির (ডিএজি) সংগ্রহে আছে এমন বহু চিত্রকৃতি (ছবি), এই প্রজন্মকে যা দিয়েছে সেই ইতিহাসকে নিজেদের শিল্পভাবনায় ফিরে দেখার প্রেরণা। নীল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ ও তাঞ্জাভুরের রেশমশিল্পীদের ইতিহাস আশ্রয়ে একতারা লার্নিং সেন্টার, লক্ষ্মীপত সিংহানিয়া অ্যাকাডেমি, মডার্ন হাই স্কুল ফর গার্লস ও সাউথ সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পড়ুয়ারা গড়েছে ইনস্টলেশন আর্ট ‘ফ্যাব্রিক অব ফ্রিডম’। স্বাধীনতার ৭৭ পূর্তিতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান রিফর্মারস গ্যালারি’তে দেখা যাবে, ১৮ অগস্ট পর্যন্ত।
ছবির শহরে
“মশাই, চেহারা উঠাইবেন?” বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে বিদেশি ফোটোগ্রাফারের স্টুডিয়োর বাইরে বাঙালি কর্মচারীর ডাক। উনিশ শতকে ইউরোপে আবিষ্কারের কিছু পরেই সে কালের কলকাতায় চল হয়েছিল ফোটোগ্রাফির। শহরের অভিজাত পাড়ায় গড়ে উঠেছিল স্টুডিয়োও। বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস-আবহে কলকাতা উদ্যাপনে মাতবে না, তাই হয়? আজ থেকে ১৯ অগস্ট, ৩টে-৮টা আইসিসিআর-এর তিনটি গ্যালারিতে প্রদর্শনী ‘ফোটোগ্রাফি চর্চা’-র উদ্যোগে। উনিশ শতকে ফোটোগ্রাফি আবিষ্কারের পর কোন বাঙালিরা আলোকচিত্র-চর্চা শুরু করেন, কী ভাবে হল তার প্রচার-প্রসার, ‘ঐতিহ্য’ শিরোনামে দেখা যাবে বেঙ্গল আর্ট গ্যালারিতে। থাকবে ক্যামেরার সাজসরঞ্জাম, ফোটোগ্রাফি নিয়ে বই, পত্রিকা। অবনীন্দ্র আর্ট গ্যালারিতে বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের কাজ, যামিনী রায় গ্যালারিতে দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের কৃতি।