ফিরহাদ হাকিম। — ফাইল চিত্র।
শহরে জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হয়ে যাচ্ছে সাততলা ভবন! এই বিষয়ে পুরসভা কেন কিছু জানে না, সোমবার প্রশ্ন তুলল কলকাতা হাই কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে এ রকম আশা করা যায় না। এমনকি, মেয়রকে দিলেন কড়া বার্তা। জানালেন, আদালত গুরুত্ব দিয়েই বিষয়টিকে দেখছে। এই বিষয়ে কলকাতা পুরসভাকে এক লক্ষ টাকা জরিমানা করল কলকাতা হাই কোর্ট। বেআইনি নির্মাণ নিয়ে পুরসভা কী পদক্ষেপ করেছে, তা-ও জানতে চেয়েছে।
জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা হয়েছিল। সেই নিয়েই সোমবার কড়া বার্তা দিল প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। বলল, ‘‘কলকাতা পুরসভা জানে না কোথায় কত জলাশয় রয়েছে? এটা হতে পারে? কলকাতা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার যদি বলেন, কতগুলি কোর্ট রুম রয়েছে জানি না! ’’ এর পরেই এই শুনানিতে কলকাতা পুরসভার দিকে আঙুল তুলেছেন প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম। তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রস্তরযুগে বাস করছি না। সব কিছু ডিজিটাইজড করা উচিত। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে এটা আশা করা যায় না। ’’ তিনি এও জানান, আদালত কাউকে ছাড়বে না। কী করে কাজ করাতে হয়, তিনি জানেন।
কী ভাবে জলাশয় রক্ষা করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যেক দিন নতুন নতুন করে সমস্যা তৈরি হচ্ছে কেন?’’ এই নিয়ে তিনি পুরসভার দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। প্রধান বিচারপতির কথায়, ‘‘জলাশয় অন্য কেউ ব্যবহার করছে। পাট্টা দেওয়া হয়েছে। বেআইনি নির্মাণ করা হচ্ছে। আপনাদের কাছে জলাশয় নিয়ে তথ্য থাকা উচিত। কতগুলি জলাশয় ছিল। এখন সেগুলির কী অবস্থা পুরসভার তা পরিদর্শন করে দেখা উচিত।’’
রাজ্যের আইনজীবী এই বিষয়ে সওয়াল করে বলেন, ‘‘পুরসভা পদক্ষেপ করছে। এক হাজারের বেশি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। পুরসভা বেআইনি কোনও কিছুর অনুমতি দেয়নি।’’ পাল্টা প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘এফআইআর দায়ের সমস্যা সমাধানের রাস্তা নয়। পুরসভা কেন বেআইনি নির্মাণ ভাঙছে না? ’’ বেআইনি নির্মাণ নিয়ে পুরসভা কী পদক্ষেপ করেছে, সেই রিপোর্টও চেয়েছে আদালত। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘বেআইনি নির্মাণ নিয়ে কী করেছেন রিপোর্ট দিন। রিপোর্ট দিয়ে জানান কতগুলি বেআইনি নির্মাণ ভেঙেছেন। আদালতকে জানাতে হবে কত জনকে নোটিস ধরিয়েছেন।’’
২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পুরসভা হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিল, ১৯৯৩ সালে কলকাতা পুরসভা এলাকায় ৩,৭৯০টি জলাশয় ছিল। ১৯৯৭ আরও কিছু জলাশয় তৈরি করা হয়। তার পর জলাশয় নতুন কোনও তথ্য পুরসভার কাছে নেই। আদালতের পর পর তিনটি নির্দেশ সত্ত্বেও কলকাতা পুরসভা এলাকায় কতগুলি জলাশয় রয়েছে, তা জানাতে পারেনি পুরসভা। আদালতের পর্যবেক্ষণ, ৯ নভেম্বর ২০২২ রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছিল। আজ পর্যন্ত সেই রিপোর্ট জমা পড়ল না। যদিও পুরসভা বার বার বলছে, পদক্ষেপ করা হচ্ছে। জলাশয় চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু সব খতিয়ে দেখে পুরসভার অবস্থান আদালতের কাছে স্পষ্ট নয়।
এই প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ২০১৪ সাল থেকে মামলা চলছে। শুধু সময়ের অপচয় হচ্ছে। এ ভাবে চলতে পারে না। পুরসভার সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করবে আদালত। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে। মনে হচ্ছে এটাই সঠিক প্রক্রিয়া হবে। গত দু’বছরে হাই কোর্টের নির্দেশ কার্যকর করা হয়নি। আদালতের সঙ্গে শুধু প্রতারণা করা হচ্ছে। এটা আসলে ১০০ শতাংশ চক্রান্ত। এখানেই থামেননি প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘‘প্রায় চার হাজার জলাশয় বন্ধ করা হয়েছে। কমপক্ষে তিন হাজার মামলা দায়ের হয়েছে। তার পরেও আদালত চুপ করে থাকবে? তা হলে আমরা পুরসভা ভেঙে দিচ্ছি। বিশেষ অফিসার নিয়োগ করছি। তিনি পদক্ষেপ করবেন। সমস্ত চক্রান্ত শেষ হয়ে যাবে।’’ প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘‘২০২১ সালের পর থেকে জলাশয় নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করেনি পুরসভা। ওই জলাশয়গুলি নানা ভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ পুরসভা চুপ করে থেকে মামলা দীর্ঘায়িত করতে চায়।’’
পুরসভার উপর আস্থা হারিয়েছে বলেও জানিয়েছে হাই কোর্ট। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, পুরসভা বলছে আগামী শুনানিতে তারা রিপোর্ট জমা দেবে। কিন্তু আদালত তাদের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। কারণ এর আগেও তারা আদালতের নির্দেশ মানেনি। তাই পুরসভা যদি ১ লাখ টাকা জরিমানা জমা দেয়, তবেই আদালত হলফনামা জমা নেবে। তিনি এও বলেন, ‘‘নির্দেশ কার্যকর করাতে আমি জানি। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে ছাড়ব। ২০২০ সাল থেকে কারা একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার এবং কাউন্সিলদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করব। প্রত্যেককে আদালতে ডেকে পাঠাব। কেউ বাধা দিতে পারবে না।’’ প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন, কী করে ভাবলেন একটা জলাশয়ের উপর সাততলা ভবন নির্মাণ হয়ে গেল আর স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার তা জানেন না? এটা কী ভাবে হয়?
মেয়রকেও কড়া বার্তা দিতে ছাড়েননি প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘‘মাননীয় মহাশয়কে গিয়ে বলুন, আদালত এটাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে নিয়েছে। অনেক কিছু হচ্ছে, মেয়রকে বলুন। এটার শেষ দেখে ছাড়ব। আপনাদের কাজের জন্য পরবর্তী প্রজন্ম ভুক্তভোগী হবে।’’ জলের সঞ্চয় নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি। মামলার পরবর্তী শুনানি ১৯ ডিসেম্বর।