নন্দরামের আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তাই ঘিঞ্জি ত্রিপলপট্টিতে জল দেওয়ার কাজ করছেন দমকলকর্মীরা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
এগারো বছর আগে খবর পেয়েছিলেন রাত দু’টো নাগাদ। তড়িঘড়ি ছুটে এলেও অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না প্রৌঢ় মহম্মদ ইব্রাহিমের। চোখের সামনে জ্বলে খাক হয়ে যেতে দেখেন নিজের দোকানটাকে।
সময় এগিয়েছে। ইব্রাহিম এখন সত্তরের কোঠায়। কিন্তু, ২০০৮ সালে অগ্নিদগ্ধ বড়বাজারের স্মৃতি আজও দগদগে তাঁর মনে। তাই শনিবার দুপুরে নন্দরাম মার্কেটের ন’তলার জানলা দিয়ে আগুনের শিখা বেরোতে দেখে কিছু ক্ষণের জন্য হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ‘আবার কি ফিরে আসবে সেই দিন’, এই আতঙ্কই গ্রাস করেছিল ইব্রাহিমের মতো ত্রিপলপট্টির সব দোকানদারকে। সে কারণেই নন্দরাম মার্কেটের আগুন নেভাতে আসা দমকলবাহিনীকে অনুরোধ করে ত্রিপলপট্টির প্লাস্টিকের ছাউনিতে জল ঢালানোর ব্যবস্থা করেন তাঁরা। যাতে বহুতল থেকে আগুনের ফুলকি ছাউনিতে পড়লেও ছড়াতে না পারে।
শেষ কুড়ি বছরে বেশ কয়েকটি বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বড়বাজারের গায়ে লেগেছে ‘অগ্নিদগ্ধ’-র তকমা। কিন্তু তার পরেও বদলায়নি ছবিটা। অন্য বহুতল বাজারের মতো জতুগৃহ হয়েই রয়েছে শতাধিক বছরের পুরনো ত্রিপলপট্টি। শনিবার সেখানে আগুন ছড়ায়নি ঠিকই। কিন্তু থরে থরে সাজানো ত্রিপল, প্লাস্টিক বেচাকেনার মধ্যেই আগুন-আতঙ্ক আজও তাড়া করে বেড়ায় ব্যবসায়ীদের। ‘‘শনিবার ধোঁয়া দেখেই সব মালপত্র গুটিয়ে নিয়েছিলাম’’— বললেন রাস্তার ধারের দোকানের প্রায় ১৫ বছরের পুরনো কর্মচারী মহম্মদ আলি।
দগ্ধ: নন্দরাম মার্কেটে পুড়ে যাওয়া কাপড়ের স্তূপ। রবিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
প্রায় কুড়ি কাঠা জমির উপরে রয়েছে এই ত্রিপলপট্টি। রাস্তার উপরেও রয়েছে কয়েকটি দোকান। তার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বাজারের ভিতরে ঢুকেছে পাঁচটি ঘিঞ্জি রাস্তা। ভিতরে সব দোকানের মাথায় বাঁশ ও প্লাস্টিকের ছাউনি। সেখানে ডাঁই করা মালপত্র। একচিলতে ফাঁকা জায়গাতেও ত্রিপল, প্লাস্টিকের স্তূপ। আবার বাজারের পিছনের দিকে এখনও এগারো বছর আগের স্মৃতি বহন করে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে পোড়া কংক্রিটের চাঁই।
২০০৮-এ প্রথম আগুন লেগেছিল এই ত্রিপলপট্টিতেই। সেখানকার আটটি বাড়ি-সহ অন্য দোকান ছাই হয়ে গিয়েছিল। সেই আগুন একে একে গ্রাস করেছিল কাশীরাম মার্কেট, নন্দরাম মার্কেটকে। ঘটনার পরে অবশ্য ত্রিপলপট্টিতে আর গড়ে ওঠেনি কোনও পাকা বাড়ি। বরং প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়েই দোকান বানিয়ে দিন কাটাচ্ছেন প্রায় দেড়শো ব্যবসায়ী। কিন্তু এ তো আরও ‘জতুগৃহ’? ‘‘কী করব বলুন? কে না চায় পাকা ছাউনি? কিন্তু এত বছরে অবস্থার উন্নতি তো হয়ইনি, বরং অবনতি হয়েছে। এখন তো প্যান্ডেল খাটিয়ে বসে রয়েছি।’’— বললেন ত্রিপলপট্টির ব্যবসায়ী আখতার আলি।
ঘিঞ্জি পরিবেশে গুদাম ও দোকান একসঙ্গে কখনওই পরিকল্পিত ব্যবসার রূপ হতে পারে না বলে মনে করেন পুরমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তাঁর মতে, ধীরে ধীরে শহরের নকশা বদলাচ্ছে। হাওড়ায় তৈরি হয়েছে লজিস্টিক হাব। আর শহর সাজাতে গেলে বড় গুদামকে কলকাতার বাইরে বার করতেই হবে। ফিরহাদ বলেন, ‘‘বারবার বলেছি, যেগুলি দাহ্যবস্তু সেগুলির গুদাম হাওড়ার লজিস্টিক হাবে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। বড়বাজারের অফিসে ২-৪টি নমুনা রেখে মালপত্র সরবরাহ হোক ওই গুদাম থেকে।’’
কিন্তু বড়বাজারের ব্যবসায়ীরা কি শুনছেন সেই কথা? মেয়রের কথায়, ‘‘শেষ পর্যন্ত সরকারকে আরও শক্ত হতে হবে।’’ শক্ত হাতে মোকাবিলার কথা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র কমল বসু, প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়েরা সকলেই বলেছিলেন। বাস্তবায়িত হয়নি কিছুই।
যেমন, প্রায় ১৬ জন শরিক একমত না হওয়ায় এগারো বছরেও পাকা দোকান তৈরি হয়নি বলে দাবি ত্রিপলপট্টির আর এক ব্যবসায়ী মেহমুদ মল্লাহের। বললেন, ‘‘আগে আমার তেতলা বাড়ি ছিল। একতলায় দোকান, উপরে গুদাম। এখন সবই প্লাস্টিকের ছাউনির তলায়। নেই জলের ব্যবস্থাও।’’ চারদিকে ডাঁই হয়ে দাহ্য বস্তু। ফের যে কোনও সময়ে জ্বলে ওঠার আশঙ্কা তাড়া করে বেড়ায় ত্রিপলপট্টির ব্যবসায়ীদের।
তাই রাতে বাড়ি যাওয়ার সময়ে সবই ‘ভগবানের’ উপরে ছেড়ে যান তাঁরা।