সঙ্কটে: বন্ধ বাসের টিকিট ছাপানোর কাজ। বাগবাজারের একটি ছাপাখানায়। নিজস্ব চিত্র
সরু-লম্বা, পাতলা কাগজে কালো ও লাল কালির ছাপা অক্ষর। যার কোনওটি নম্বর, তো কোনওটি ওই কাগজের মূল্য। অফিস থেকে ফিরে বাবা-কাকারা সেই কাগজের টুকরো দিতেন বাড়ির খুদে সদস্যটিকে।
বাসের টিকিট জমানোর সেই স্মৃতি এখনও টাটকা অনেকের। করোনা আতঙ্ক এ বার সেই টিকিট ছাপানোর ব্যবসায়ীদেরও সঙ্কটে ফেলেছে। কারণ, আনলক পর্বে বাস পথে নামলেও টিকিট ছাপানোর মেশিন কিন্তু বন্ধ। শহরে যে কয়েকটি ছাপাখানায় এই টিকিট ছাপা হয়, তার মালিকেরা জানাচ্ছেন, আগে দিনে দেড়-দুই লক্ষ টিকিট ছাপা হত। এখন তাঁদের বসেই দিন কেটে যাচ্ছে।
তা হলে কি বেসরকারি বাসে টিকিট ব্যবস্থা উঠে গেল? বাস-মিনিবাস সংগঠনের কর্তারা জানাচ্ছেন, তেমনটা নয়। তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘যাত্রীই তো নেই। টিকিট ছাপিয়ে কী হবে?’’ বাসমালিকেরা জানাচ্ছেন, লকডাউনের আগে একটি বাসের জন্য একসঙ্গে ৫০ হাজার টিকিট ছাপানো হত। লম্বা রুটে সেই টিকিট ৫০-৬০ দিন আর ছোট রুট হলে তা ৮০-৯০ দিন চলত। উত্তর শহরতলির এক বাসমালিকের কথায়, ‘‘ঘরে যা টিকিট রয়েছে, তা কবে শেষ হবে তারই ঠিক নেই।’’ ‘অল বেঙ্গল বাস মিনিবাস সমন্বয় সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক রাহুল চট্টোপাধ্যায় জানান, লকডাউনের আগে শহর ও শহরতলির একটি বাসে সারাদিনে ৭৫০-৮৫০ জন যাত্রী হত। মিনিবাসে হত ৪৫০-৫৫০। এখন সবেতেই সেই সংখ্যা ২০০-২৫০ জনে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: পাচার হওয়া কিশোরী উদ্ধার মহারাষ্ট্রে
বাসমালিকদের কথায়, প্রতিদিন আটশো যাত্রী হলে ৫০ হাজার টিকিট ৬২-৬৩ দিনে শেষ হত। দুশো যাত্রী হলে ৫০ হাজার টিকিট ২৫০ দিন চলবে। ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটস’-এর যুগ্ম সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধায়ের কথায়, ‘‘অনেকেই আছেন, যাঁরা শুধু বাসের টিকিট ছাপান। কিন্তু যাত্রী কমে যাওয়ায় টিকিট ছাপার চাহিদাই নেই।’’ ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ছাপাখানার মালিক সালকিয়ার গৌতম পাইন, বজবজের সন্তোষপুরের ভাস্কর মাইতি, বাগবাজারের অমর দেবনাথ-সহ অনেকে। গৌতমবাবু বলেন, ‘‘৫০ হাজার টিকিট ছাপিয়ে ৭০০-৮০০ টাকা পেতাম। এখন কী করব জানি না।’’
আরও পড়ুন: ডিজ়েলের দাম বৃদ্ধিতে কমছে বাস
আগে বিভিন্ন সংস্থার বার্ষিক রিপোর্টের বইয়ের পৃষ্ঠা কেটে ছাপা হত এই টিকিট। এখন শিয়ালদহের বৈঠকখানা বাজারের বাতিল কাগজের দোকান থেকে প্রতি কিলোগ্রাম ৩৪ টাকা দরে বাতিল ফোটোকপির কাগজ কিনে হাত মেশিনে ছাপানো হয়। লাল অক্ষরে থাকে বাসের নম্বর। বাকিটা থাকে কালো কালিতে। তিরিশ বছর ধরে উত্তর শহরতলির ১০-১২টি রুটের টিকিট ছাপাচ্ছেন অমর দেবনাথ। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘চওড়ায় পৌনে এক ইঞ্চি, লম্বায় আড়াই ইঞ্চি মাপের টিকিট রোজ দেড় লক্ষ ছাপাতাম। জানি না কবে সেই কাজ শুরু করব।’’ বাবা-কাকার মতোই টিকিট ছাপান ভাস্কর মাইতি। শ’তিনেক বাসের জন্য মাসে ২৩-২৫ লক্ষ টিকিট ছাপতেন। স্নাতক যুবকের কথায়, “সংসার চালাতে বিকল্প কাজের খোঁজ করতে হবে কি না ভাবছি।’’
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল বাস-মিনিবাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর যুগ্ম সম্পাদক প্রদীপনারায়ণ বসুর কথায়, ‘‘একটি বাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে অনেক রুটি-রুজি জড়িয়ে থাকে। তেমনই ওই ছাপাখানা। যাত্রী কমার জন্য এখন টিকিট ছাপানোর বরাত দেওয়াও বন্ধ।’’ বাসমালিক থেকে টিকিট ছাপানোর ব্যবসায়ী— সকলেরই আশঙ্কা, সরকারি বাসের মতো বেসরকারি বাসেও টিকিটের যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হলে পৌনে এক ইঞ্চি বাই আড়াই ইঞ্চির কাগজ শুধুই স্মৃতির কোঠায় থেকে যাবে না তো!