—প্রতীকী চিত্র।
গোকুলে বাড়েন তাঁরা।
কাকভোরের বাসে প্রশিক্ষিত চালককে পাশে বসিয়ে নিজেরা স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বাস চালান। সেই বাসে তখন যাত্রীরাও থাকেন। প্রশিক্ষণ ছাড়াই এ ভাবে মানুষের জীবন বাজি রেখে ধীরে ধীরে খালাসি থেকে তৈরি হন এক জন বাসচালক। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে বেশির ভাগ সময়েই চালক ও খালাসি উধাও হয়ে যান। জীবন বিপন্ন হয় যাত্রীর। আর্থিক লোকসান হয় বাসমালিকের।
ভিআইপি রোডের উপরে লেক টাউনের কাছে রবিবার রাতে একটি গাড়িকে ধাক্কা মারে ৪৪ রুটের একটি বাস। অভিযোগ, চালক তেল চুরির পরে বাসটি স্ট্যান্ডে ফেরাতে এসে পুলিশ ও বাসমালিকের তাড়া খেয়ে পালানোর সময়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়িতে ধাক্কা মারে। তাতে তিন জনের মৃত্যু হয়। অভিযুক্ত চালক গাজিউল্লা মোল্লাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাসমালিকেরা জানান, গাজিউল্লা আগে রাজারহাটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চালাত। পরে ৪৪ রুটে আসে। কিন্তু মাদকাসক্তি ও অসদুপায় অবলম্বনের প্রবণতার কারণে এক বছর আগে তার চাকরি যায়। বর্তমানে সে কোথাও বাস চালাচ্ছিল না।
ওই দুর্ঘটনার পরে ‘সিটি সাবার্বান বাস সার্ভিস’-এর তরফে অভিযোগ করা হয়, বাসের চালককে নিয়োগের আগে তাঁর দক্ষতা কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার তেমন উপায় নেই। সংগঠনের সভাপতি টিটু সাহা জানান, রুটের সম্পাদকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, নিয়োগের আগে চালক কোথায় কাজ করেছেন, তার শংসাপত্র চাইতে হবে।
বাসমালিকদের প্রশ্ন, গাড়ি চালানো শেখার কেন্দ্র থাকলে কেন বাস চালানো শেখার কেন্দ্র থাকবে না? সরকারি নিয়মে, গণপরিবহণের লাইসেন্স পাওয়ার আগে চালককে ছোট-বড় মালবাহী গাড়ি, ক্যাব, ট্যাক্সি চালাতে হয়। প্রতি ক্ষেত্রেই তার জন্য লাইসেন্স রয়েছে। শেষ ধাপ গণপরিবহণ অর্থাৎ বাস। এর জন্য সব মিলিয়ে বছর তিনেক সময় লাগে।
যদিও বাসমালিকদেরই একটি অংশের অভিযোগ, দালালের মাধ্যমে লাইসেন্স বার করে নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাস চালাতে চলে আসেন লোকজন। খালাসি হিসেবে চালকের পাশে বসে বসে তাঁরা গাড়ি চালানো শেখেন। এর পরে মালিকের অজানতেই ভোরের প্রথম ট্রিপে সেই সব খালাসির হাতে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে পাশে বসে চালক গাড়ি চালানো শেখান। সেই বাসে যাত্রীরাও থাকেন। এক বাসমালিকের কথায়, ‘‘দুর্ঘটনা ঘটালে যাত্রীর জীবন বিপন্ন হয়, পুলিশ আমাদের বাস টেনে নিয়ে যায়। আমরা হেনস্থা ও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ি। কিন্তু ব্যবসা চালাতে গেলে এই আপস করতে হয়। গাড়ি চালানো শিখতে দেখা যায়। বাস চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে দেখা যায় কি? তবে এত চালক আসছেন কী ভাবে?’’
টিটু সাহার কথায়, ‘‘আমাদের এখানে বাসচালক তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রয়োজন। যাঁরা বাস চালাতে আসেন, তাঁরা বাসের আগে আর কোনও গাড়ি চালিয়েছেন কি না, তার কোনও প্রমাণপত্র থাকে না। সবটাই চলে মুখের কথায়। আমরা সরকারের কাছে অনেক বার আবেদন করেছি বাসচালকদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে।’’ মালিকেরা জানান, ভাল চালক সরকারি বাসের চাকরি করতে চলে যান। বেসরকারি বাসে অধিকাংশ চালকই নিযুক্ত হন রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। অভিযোগ, মালিক বাধ্য হন সেই চালকের দক্ষতা পরীক্ষা না করেই তাঁকে নিয়োগ করতে।
রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী অবশ্য বাস চালানোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালুর বিষয়ে আলোকপাত করেননি। তবে তিনি বলেন, ‘‘খালাসিদের দিয়ে বাস চালানো যাতে না হয়, তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমরা সতর্ক করি। বাসচালকেরা প্রশিক্ষণ নিয়েই গাড়ি চালান। দক্ষতার অভাবে নয়, ট্র্যাফিক আইন ভাঙতে গিয়েই তাঁরা দুর্ঘটনা ঘটান। তবে দালালচক্র নিয়ন্ত্রণ করতে এখন অনলাইনে লাইসেন্স দেওয়া হয়। মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।’’